হিরোশিমার ছায়া গাজায়: খান ইউনিসে নারকীয় হামলা, নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে ইসরাইল!
চোখের পলকে ধুলোর সঙ্গে মিশে গেলো শত শত ঘরবাড়ি। চারদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ আর মানুষের বুকচিরে বেরিয়ে আসা আর্তনাদ। হ্যাঁ, কথাগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য নয়—এই বাস্তবতা গাজার খান ইউনিস শহরের। গেল সোমবার সেখানে ফের ভয়ংকর এক হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা, ধোঁয়ায় ঢেকে যায় আকাশ, আর সেই ধোঁয়া কেটে গেলে দেখা যায়—যেখানে একসময় ছিলো মানুষের মুখর বসতি, সেখানে এখন শুধু বিশাল গর্ত।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এই অভিযানকে ‘সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত অপারেশন’ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও, বাস্তবে এটি ছিলো বেসামরিকদের উপর এক নির্মম আক্রমণ। আইডিএফ নিজেই প্রকাশিত ফুটেজে দেখা যায়—গাজার আকাশজুড়ে হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান, নিচে নির্বিচারে বোমা ফেলা হচ্ছে আবাসিক এলাকায়। প্রতিটি বিস্ফোরণ মুহূর্তেই কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য প্রাণ, ধ্বংস করে দিচ্ছে জীবনভিত্তি।
মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে প্রাণ হারিয়েছেন অগণিত নিরীহ ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও বহু মানুষ, যাদের অনেকেই এখন চিকিৎসা ছাড়াই মৃত্যুর প্রহর গুনছেন বিধ্বস্ত হাসপাতালগুলোর বারান্দায়।
তিন পরাশক্তির হুঁশিয়ারি: থামো ইসরাইল, না হলে নিষেধাজ্ঞা!
ইসরায়েলের এই বর্বরোচিত আচরণের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহল এবার আরও কড়া অবস্থান নিচ্ছে। সোমবার একযোগে বিবৃতি দিয়েছে তিনটি বিশ্বশক্তি—যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং কানাডা। তারা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, গাজায় এই সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকলে ইসরাইলকে নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে।
এই তিন দেশের পাশাপাশি আরও ২২টি রাষ্ট্র ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়িয়েছে, যাতে গাজায় পূর্ণাঙ্গ ত্রাণ সরবরাহ চালু করা হয়। মানবিক সহায়তা বন্ধ রাখার পেছনে কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছে তারা।
কিন্তু আন্তর্জাতিক এসব চাপকে প্রকাশ্যে তুচ্ছ করে দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, “ইসরায়েল কোনো চাপের কাছে মাথা নত করবে না। গাজায় সামরিক অভিযান চলতেই থাকবে।” তার এই একগুঁয়েমি গাজার মানুষের জন্য মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর করে তুলছে।
ত্রাণও বন্ধ, যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর ‘ঝুঁকির অজুহাত’
জাতিসংঘ জানিয়েছে, সোমবার ত্রাণবাহী ৫০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশের জন্য আবেদন করলেও ইসরায়েল মাত্র ৯টি ট্রাককে অনুমতি দিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এই সংখ্যাকে “সমুদ্রের মাঝে একফোঁটা পানি” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইসরায়েল অবশ্য দাবি করছে, অতিরিক্ত ত্রাণ পাঠালে সেগুলো হামাসের দখলে যেতে পারে, সেই ঝুঁকি এড়াতেই ত্রাণ সরবরাহ সীমিত রাখা হয়েছে। নেতানিয়াহু আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরামর্শ করে এখন নতুনভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, যেখানে পুরো প্রক্রিয়া আইডিএফের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ‘ঝুঁকির অজুহাত’ আসলে গাজার উপর চাপ বজায় রাখার একটি পরিকল্পিত কৌশল। এতে আক্রান্ত হচ্ছে গাজার নিরীহ জনগণ, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা।
মানুষের নদী ঘরছাড়া, পথে পথে বিভীষিকা
খান ইউনিস শহরের বর্তমান চিত্র যেন এক চলন্ত যুদ্ধক্ষেত্র। প্রতিটি মুহূর্তে সেখানে বোমা পড়ছে, ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ছে, মানুষ ছুটছে প্রাণ বাঁচাতে। অনেকেই কাঁধে করে শিশু ও বৃদ্ধ স্বজনদের নিয়ে ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কেউবা সাইকেলে, কেউ পায়ে হেঁটে মরুভূমির মতো উত্তপ্ত সড়কে রওনা হয়েছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে।
ঘর হারানো মানুষের চোখে মুখে শুধুই আতঙ্ক, বেদনা আর ক্ষোভ। ছোট ছোট শিশুরা কাঁদছে, মায়েরা তাদের বোঝাতে ব্যর্থ, বাবারা অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে ধ্বংসস্তূপের দিকে।
এই পরিস্থিতি দেখে অনেকেই বলছেন—“গাজায় এখন হিরোশিমার ছায়া।” যুদ্ধ যে কেবল মাটির উপর যুদ্ধ নয়, মানুষের আত্মার উপরও তা ছায়া ফেলে।
শেষ আশঙ্কা: আরেকটি মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে গাজা
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে গাজার দিকে। জাতিসংঘের তরফে মানবিক বিপর্যয় ঘোষণা করার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু তার আগেই যদি সহায়তা না পৌঁছে, তাহলে আরও কয়েক হাজার মানুষ অনাহারে ও আহত অবস্থায় মারা যেতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি ইসরাইল এখনই থামানো না যায়, তবে এটি হতে পারে বিংশ শতাব্দীর পর আরেকটি ইতিহাস বদলানো গণহত্যা।
শেষ কথা:
গাজা আজ রক্তাক্ত। খান ইউনিস আজ এক জীবন্ত হিরোশিমা। আন্তর্জাতিক চাপ, মানবিক আবেদন—সবকিছু উপেক্ষা করে চলেছে বোমা আর গোলাগুলির খেলা। বিশ্ব কি থামাতে পারবে এই ধ্বংসযজ্ঞ? নাকি চোখের সামনে আরেকটি জাতি বিলুপ্ত হবে ইতিহাসের নিষ্ঠুর অধ্যায়ে?