গ্রামের চা-স্টল যেন রাজনীতির অনানুষ্ঠানিক ক্লাবঘর
ঈদের ছুটি। শহরমুখী মানুষ ফিরে এসেছে আপন গাঁয়ে। চারদিকে আনন্দ, মিলনমেলা। কিন্তু গ্রামের সবচেয়ে জমজমাট জায়গা কোথায়? মসজিদের চত্বর, ঈদগাহ ময়দান, না আত্মীয়ের উঠোন? না, সব ভুল! সবচেয়ে প্রাণবন্ত জায়গা হলো “গ্রামের চা-স্টল।”
এই চা-স্টল যেন গ্রামীণ জীবনের এক কেন্দ্রস্থল, এক কথায় বলা যায়, “অফিসিয়াল আনঅফিশিয়াল ক্লাবঘর।” সকালবেলা হাঁটতে বের হওয়া মানুষ থেকে শুরু করে বিকেলে হাটে আসা চাষি পর্যন্ত, সবাই একবার না একবার এই চা-স্টলে ঢুঁ মারে। তবে ঈদের সময় চিত্রটা আরও বর্ণিল হয়ে ওঠে।
চায়ের কাপেই রাজনীতি!
চা-স্টলে গিয়ে মনে হয়, এখানে সবাই একেকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক। পত্রিকা পড়ুক বা না পড়ুক, টিভি দেখুক বা না দেখুক; দেশের সবকিছু নিয়ে এদের মতামত আছে।
কে প্রধানমন্ত্রী হবে, কাকে গ্রেপ্তার করা উচিত, কার বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে, এসব নিয়ে এমন আলোচনা চলে, যেন সবাই হোম মন্ত্রী!
চায়ের কাপে ভাসতে থাকা চিনি না থাকলেও, রাজনীতির উত্তাপ থাকে শতভাগ। কেউ বলে, “এই সরকার যদি আরও ৫ বছর থাকে, তাহলে শেষ!” আরেকজন তৎক্ষণাৎ জবাব দেয়, “তখনই তো উন্নয়ন হবে ভাই! পদ্মা সেতু কি আকাশ থেকে পড়েছে?”
এক সময় দেখা যায়, এই তর্ক ঠেলে ঠেলে ঢুকে গেছে মুক্তিযুদ্ধ বনাম রাজাকার, আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি, কিংবা ধর্মভিত্তিক দল বনাম সেক্যুলার ভাবধারা ইত্যাদি গভীর বিতর্কে।
মজার ব্যাপার হলো, এখানে কেউই নিরপেক্ষ না। কেউ হয়তো দল করে না, কিন্তু কথা এমন বলবে যেন তার বিশাল রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে। একজন বলল, “আমি গতবার ঢাকায় গিয়েছিলাম, একজন বড় নেতার সাথে দেখা হয়েছিল। উনি নিজেই বলেছে এই সরকার বেশিদিন টিকবে না।”
আরেকজন হাসতে হাসতে বলে উঠল, “শোন ভাই, তুই তো দেখি অনেক বড় গবেষক! তোর কথা শুনলে তো ভাবি BBC থেকেও তোকে ডাকা উচিত!”
তর্ক এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, পাশের দোকানের মুড়ি বিক্রেতাও মাঝে মাঝে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, “এই দেশের কিছু হবে না ভাই, চা খাও, দেশকে নিয়ে ভাবার দরকার নাই।”
চায়ের সঙ্গে ঝগড়ার স্বাদও মেলে
এই চা-স্টল কেন্দ্রিক আলোচনায় মাঝেমধ্যে গলা চড়া হয়। “তুই বলিস কি রে!” “তুই আগে দলের নাম শিখ, তারপর কথা কা!” এ ধরণের চিল্লাচিল্লি একেবারে স্বাভাবিক।
তবে বেশিরভাগ সময়ই তা হাসিঠাট্টার মাঝেই শেষ হয়। কেউ রাগ করে উঠেই চলে যায়, পরে আবার ঠান্ডা মাথায় ফিরে আসে, আর বলে, “চল ভাই, আরেক কাপ চা খাই।”
এই চা-স্টল শুধু রাজনীতি বোঝার জায়গা নয়। এখানেই গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব, পুরনো সম্পর্কের নবায়ন হয়, ঈদের খুশির ভাগাভাগি চলে।
কার ছেলে কবে বিদেশ যাবে, কে চাকরি পেল, কে বাড়ি করছে ; এসব খবরও এখানে প্রচার হয়। তাই একে বলা যায় “গ্রামের বিবিসি নিউজ চ্যানেল।”
গ্রামের চা-স্টল শুধু চা খাওয়ার জায়গা নয়। এটি হলো মানুষের আবেগ, মতামত, অভিমান আর বন্ধুত্বের মিলনমঞ্চ। এখানে রাজনীতি হয়, তর্ক হয়, আবার হাসিও হয়।
এই জায়গাগুলোর মধ্যে দিয়ে গ্রামীণ সমাজের চিন্তা, রুচি, ও রাজনৈতিক চেতনার প্রতিফলন ঘটে। তাই হয়তো বলা যায়,
“চায়ের কাপ ছোট হলেও, তাতে রাজনীতির ঢেউ বিশাল।”
আবু সাঈদ আল হানাফি
শিক্ষার্থী : জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা



















