জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে এক ঐতিহাসিক কর্মসূচির সূচনা করেছে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দীর্ঘ ৩৬ দিনব্যাপী এ আয়োজনে থাকবে শহীদদের স্মরণ, বিচারের দাবি, সংস্কৃতি চর্চা, জনতার অংশগ্রহণ এবং দেশের প্রতিটি স্তরে ঐক্যের প্রতিফলন। এই কর্মসূচির প্রতিটি দিনকে উৎসর্গ করা হয়েছে আন্দোলনের একেকটি অধ্যায়, একেকটি আবেগ আর প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবিকে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক সরকারি বিবৃতিতে মঙ্গলবার (২৫ জুন) এই মাসব্যাপী মহাপরিকল্পনার বিস্তারিত জানানো হয়। সরকার বলছে, এই কর্মসূচি শুধু স্মৃতিচারণ নয়—এটি একটি জাতিগত আত্মচেতনার জাগরণও।
১ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে এই স্মরণযাত্রা। এদিন দেশের মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডায় শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় প্রার্থনা ও দোয়ার আয়োজন থাকবে। একইদিনে জুলাই গণহত্যার বিচারের দাবিতে জাতীয় গণস্বাক্ষর কর্মসূচির সূচনা হবে, যা চলবে আগস্টের ১ তারিখ পর্যন্ত।
এছাড়া, শহীদদের স্মরণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে একটি বিশেষ শিক্ষাবৃত্তি চালু করা হবে।
এই দিনটিতে দেশব্যাপী পোস্টারিং এর মাধ্যমে প্রকাশ পাবে দীর্ঘদিন ধরে চলা অবৈধ সরকারের নিপীড়নের বিবরণ।
৭ জুলাই চালু হবে বিশেষ ওয়েবসাইট “Julyforever.org”, যা এই আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রাখবে ডিজিটাল আর্কাইভ হিসেবে।
মূল ইভেন্ট শুরু হবে ১৪ জুলাই থেকে। দিনটিকে নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই দিনে একজন শহীদ পরিবারের সাক্ষ্য, ভিডিও শেয়ারিং, ৬৪টি জেলায় এবং দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী, টিএসসিতে প্রজেকশন ম্যাপিং ও ড্রোন শো থাকবে।
প্রতিদিন আলাদা থিমে ভিডিও শেয়ার, নাট্য আয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মরণ অনুষ্ঠান, প্রতীকী কফিন মিছিল, শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা, গান, ভিআর শো এবং শহীদদের স্মরণে সভা—এসব থাকবে ১৫ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত।
২১ জুলাই থেকে শুরু হবে শিশু শহীদদের নিয়ে আয়োজন। থাকবে গ্রাফিতি প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন, শিশুদের জন্য জুলাই থিমে গ্রাফিক নভেল প্রকাশ, শিশু অ্যাকাডেমিতে ভাস্কর্য স্থাপন, এবং দেশের সব মাদ্রাসায় স্মরণসভা।
২৫ জুলাই শুরু হবে মঞ্চনাটকের মাধ্যমে বিপ্লবী চেতনার বহিঃপ্রকাশ। এরপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রদের জমায়েত, বাংলা একাডেমিতে জুলাই বইমেলা, গণমাধ্যমে সাংবাদিকদের সংহতি ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আলোচনার আয়োজন।
২৯ জুলাই বিশেষভাবে উদযাপন করা হবে ‘বাংলা মা’ দিবস হিসেবে, যেখানে থাকবে শ্রমিক সমাবেশ ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপ।
৩১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হবে পূর্ণ মাত্রার জাতীয় স্মরণ আয়োজন।
৩১ জুলাই “কাণ্ডারি হুঁশিয়ার” থিমে দেশজুড়ে কলেজে স্মরণসভা।
আগস্টের ১ তারিখ “গণজোয়ার” শিরোনামে দূতাবাসগুলোতে প্রদর্শনী এবং কফি টেবিল বুক প্রকাশ।
২ আগস্ট “আমি বাংলায় গান গাই” থিমে অনুষ্ঠিত হবে মায়েদের নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান।
৩ আগস্ট রিকশা মিছিল, তথ্যচিত্র প্রদর্শনী এবং বিশাল শোভাযাত্রা।
৪ আগস্ট কার্টুন প্রদর্শনী, “স্পটলাইট অন জুলাই হিরোজ” ডকুমেন্টারি।
৫ আগস্ট “শোনো মহাজন” — শহীদ পরিবারকে সম্মাননা, বিজয় মিছিল, এয়ার শো ও গানের মহাযজ্ঞ।
পুরো কর্মসূচি জুড়ে স্পষ্ট যে এটি শুধুই শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন নয়—এটি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জাগিয়ে তোলার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই বিশাল কর্মসূচি যেন হয়ে উঠেছে একটি চলমান মুক্তিযুদ্ধ—সাহস, প্রতিবাদ, সংস্কৃতি আর জনতার সম্মিলনে গড়ে ওঠা একটি গণজোয়ার।
এই ৩৬ দিনের কর্মসূচি ইতিহাসের পুনরুত্থান নয়, এটি ভবিষ্যতের রচনাও। একটি প্রজন্মের আত্মত্যাগ, আরেক প্রজন্মের দায়িত্ব।
এটি কেবল একটি স্মরণ অনুষ্ঠান নয়—একটি জাতির প্রত্যাবর্তনের আয়োজন।