close

লাইক দিন পয়েন্ট জিতুন!

গল্প: চিঠি

Anwarul Hoque avatar   
Anwarul Hoque
****

 

সকালবেলা কুয়াশা নামেনি এখনো, তবে হাওয়া কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা। গ্রামের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে রফিক। একটা হ্যান্ডব্যাগ কাঁধে, চোখে-মুখে একটু উদ্বেগ, একটু বিষণ্নতা। মা রান্নাঘর থেকে হাঁক দিলেন, “খিচুড়ি দিয়ে গেলাম থালায়, কিছু মুখে না দিয়ে যাস না।”
বাবা চুপচাপ বসে আছেন কুলগাছটার নিচে। রফিক একটু কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে বলল, “আসি, আব্বা।”
বাবা শুধু বললেন, “সাবধানে যাইস।”
রফিক জানে—এই "সাবধানে যাইস" শব্দটার ভেতরেই আছে হাজারটা না বলা কথা, হাজারটা দোয়া।
ছোটবেলায় সে কেঁদে পড়ত মায়ের কোলে, স্কুলে যাওয়ার নাম শুনলেই। এখন বড় হয়েছে—চাকরি করে সিলেটে। কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বিদায় নিতে গেলে আজও চোখে পানি আসে।
প্রথমে গ্রামের ভ্যানে চড়ে হাটে গেল। সেখান থেকে বাসে চড়ে শহরে, শহর থেকে বেবি ট্যাক্সিতে রওনা হল ট্রেন স্টেশনের দিকে। ট্রেন ছাড়বে সন্ধ্যায়। স্টেশনে বসে সে ভাবল—এই একেকটা বিদায় যেন একেকটা ছোট মৃত্যু।
ট্রেনে জানালার পাশে বসে রফিক জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। রাতভর ট্রেন চলল, আর রফিকের চোখের সামনে ভেসে উঠল বাবার মুখ, মায়ের চোখের জল, আর সেই ছোট উঠোনটা।
পরদিন সকালে সিলেট পৌঁছাল। মেসে ঢুকে বিছানায় পড়ে রইল কিছুক্ষণ। দুপুরে উঠে ব্যাগ থেকে কাগজ-কলম বের করল। লিখতে বসল—
> “প্রিয় মা ও বাবা,
আসসালামু আলাইকুম।
ভালোভাবে পৌঁছেছি। ট্রেনে ভিড় ছিল, কিন্তু চিন্তার কিছু হয়নি। খাবারটা খেয়েছি, খিচুড়ি খুব ভালো লেগেছে। আব্বা কিছু বলল না, কিন্তু আমি বুঝেছি—তিনি খুব কষ্টে ছিলেন।...”
এক পৃষ্ঠা, দুই পৃষ্ঠা… রফিক লিখে গেল মন খুলে। যেন নিজের সঙ্গে কথোপকথন, আবার যেন দূরে বসে থাকা মায়ের কানে কথাগুলো পৌঁছানোর চেষ্টা।
চিঠিটা পাঠাল সে পোস্ট অফিস থেকে। ফিরে এসে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে হিসেব করল—মা-বাবা চিঠি পাবে অন্তত ১২-১৫ দিন পর।
সেইদিন বিকেলে মা উঠোনে বসে বললেন, “আজ চিঠি আসবে না বুঝি?”
বাবা চায়ের কাপ হাতে রেখে বললেন, “কাল দেখিস, আসবেই।”
এরকম আরও কয়েকদিন গেল। অবশেষে একদিন ডাকপিয়ন সাইকেল চেপে এসে ডাকল—
“খালাম্মা! রফিক সাহেবের চিঠি!”
মা দৌড়ে গিয়ে চিঠি নিলেন। হাতে নিয়েই চোখে পানি চলে এল। বাবাকে পড়তে দিলেন। বাবা চশমা পরে আস্তে আস্তে পড়তে লাগলেন—চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন তাদের বুকের মধ্যে নতুন আলো জ্বালাল।
মা চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরে বললেন, “আমার পোলাডা ভালো আছে, আলহামদুলিল্লাহ।”
চিঠিটা তারা যত্ন করে রেখে দিলেন সেই পুরনো টিনের ট্রাংকের ভেতর—যেখানে আগে রফিকের স্কুলের সার্টিফিকেট রাখা ছিল।
বছর পেরিয়ে গেছে। এখন মোবাইল আছে, ভিডিও কল আছে, হোয়াটসঅ্যাপ আছে। কিন্তু মা সেই ট্রাংকের তালা খুলে মাঝে মাঝে পুরনো সেই চিঠিটা বের করে পড়েন।
কারণ মা জানেন, এই চিঠিতে শুধু খবর ছিল না—ছিল একটা সন্তানের ভালোবাসা, ছিল না বলা যত্ন, আর ছিল ফেরার প্রতিশ্রুতি।

कोई टिप्पणी नहीं मिली