বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ ও তাদের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (পূর্বের নাম এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক) মাধ্যমে প্রায় ৪৯ কোটি ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার ঘটনায় ২৬ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুটি পৃথক মামলা দায়ের করেছে।
দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর উপ-পরিচালক সুবেল আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। মামলা দুটি দায়ের করেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক বিলকিস আক্তার, যিনি এ জালিয়াতি নিয়ে একাধিক মাস ধরে অনুসন্ধানে ছিলেন।
অভিযোগপত্র অনুযায়ী, মামলার মূল অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ভাই ও মেয়ে জামাই, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ভাই এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা। এদের সঙ্গে চট্টগ্রামের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপ সাদ মুসা গ্রুপ এবং তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মাহমুদ সাজিদ কটন মিলস লিমিটেড-এর সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করা হয়েছে।
দুদকের এজাহার অনুসারে, ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়কালে তৎকালীন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই ঋণ জালিয়াতি সংঘটিত হয়। যথাযথ জামানত ছাড়াই এবং সঠিক যাচাই-বাছাই না করে দুইটি ঋণ অনুমোদন করা হয় — যার পরিমাণ যথাক্রমে ২৯ কোটি ১৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা এবং ২০ কোটি ৫২ লাখ ৯৩ হাজার টাকা।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, এই বিশাল অঙ্কের ঋণ মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়, যা একটি সুস্পষ্ট প্রশাসনিক ব্যত্যয় ও দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঋণের জন্য কোনো মূল প্রস্তাবনা যাচাই, জামানত মূল্যায়ন, বা ক্রেডিট রিস্ক বিশ্লেষণ ছাড়াই ঋণ সুপারিশ ও অনুমোদন করা হয়। এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং বোর্ড মেম্বার।
মামলা দুটি দায়ের করা হয়েছে দণ্ডবিধির ৪০৯, ৪২০, ১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২)(৩) ধারা অনুযায়ী। এতে একদিকে যেমন প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ, তেমনি মানি লন্ডারিংয়ের মতো মারাত্মক অপরাধও উল্লেখ রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অভিযুক্তদের অনেকেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ এবং চট্টগ্রামের প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে জড়িত। ফলে এই মামলার বিচারিক ও তদন্ত প্রক্রিয়া রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে দুদকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘‘কোনো চাপেই আমরা নতি স্বীকার করব না। যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দেওয়া হবে।’’
এ ধরনের বড় জালিয়াতি আবারও বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নামে পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও এধরনের জালিয়াতি জনমনে প্রশ্ন তুলেছে — ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদারকি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি এবং রাজনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত?
ব্যাংক জালিয়াতি কোনো সাধারণ অপরাধ নয় — এটি অর্থনীতির হৃদপিণ্ডে আঘাত। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে সংঘটিত এই ৪৯ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি শুধু আর্থিক নয়, বরং নৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার ভয়াবহ উদাহরণ। এখন দেখার বিষয়, এই মামলার তদন্ত ও বিচার কতটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হয়।



















