ঢাকাই চলচ্চিত্রের পরিচিত মুখ, চিত্রনায়িকা নুসরাত ফারিয়াকে সম্প্রতি হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ১৮ মে সকালে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে ইমিগ্রেশন পুলিশ আটক করে এবং পরবর্তীতে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়। এরপর তাকে আদালতে হাজির করা হলে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে ২২ মে শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেন।
এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক। বিশেষ করে গ্রেপ্তারের পেছনে প্রকৃত কারণ নিয়ে দেখা দিয়েছে ব্যাপক প্রশ্ন। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের দুজনেই এই ঘটনাকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
"শুধু একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য জেলে?" — প্রশ্ন তুললেন জুলকারনাইন সায়ের
জুলকারনাইন সায়ের তার ফেসবুকে বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি ব্যাখ্যা দিতে পারবে কেন নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তার করা হলো? তার অপরাধ কী ছিল? শুধুমাত্র 'মুজিব' বায়োপিকে শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয়ের কারণেই কি তাকে টার্গেট করা হলো?” তিনি এটিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্য উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং দাবি তোলেন, “ফারিয়াকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে এবং তার হয়রানির জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।”
তার আরও দাবি, “এই ঘটনা প্রমাণ করছে বাংলাদেশ এখন এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে যে কাউকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে শুধুমাত্র রাজনৈতিক আবহের কারণে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি ‘রিফর্মেটরি’ ভূমিকা পালন করার বদলে প্রতিশোধমূলক আচরণ করছে, যা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত।”
ডেভিড বার্গম্যানের মতে, এটি ‘দায়বদ্ধতার পোশাক পরা প্রতিশোধ’
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, “নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার গভীর উদ্বেগজনক। তিনি একজন শিল্পী। শুধুমাত্র শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করাই কি তার অপরাধ?” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে বর্তমানে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যেখানে আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া বা কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট থাকাটাই অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে।”
বার্গম্যান স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “দেশের তথাকথিত নতুন ‘সিভিল সোসাইটি’ এখন সুবিচারের পথে হাঁটছে না। বরং তারা প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব দেখাচ্ছে। এটি আইনের শাসনের জন্য একটি ভয়ংকর বার্তা।”
ফারিয়ার বিরুদ্ধে মামলা কীভাবে এলো?
জানা যায়, গত ২৯ এপ্রিল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা চেষ্টার মামলায় নুসরাত ফারিয়াসহ ১৬ জন শিল্পীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মামলার বাদী এনামুল হক অভিযোগ করেন, একটি রাজনৈতিক নাটকীয়তার অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৮৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ৩০০-৪০০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে এজাহার দাখিল করা হয়।
এই মামলার প্রকৃত প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। অনেকে বলছেন, এটি এক ধরনের ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হেনস্থা’, যার লক্ষ্য হচ্ছে একটি রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনায় সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই হতবাক ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। প্রখ্যাত নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেছেন, “এই গ্রেপ্তার স্বাধীন চিন্তা ও শিল্পের প্রতি এক ধরনের আঘাত। একজন শিল্পীকে তার কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন
এই ঘটনায় এখনো কোনো বড় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দেওয়ায় অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেছেন। একাধিক বিশ্লেষকের মতে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এ নীরবতা এ অঞ্চলের রাজনীতি ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার কেবল একজন অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা নয়, এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং রাজনৈতিক সহনশীলতার ওপর একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এর তীব্র সমালোচনা করছেন। এখন দেখার বিষয়, সরকার এই সমালোচনার জবাবে কী পদক্ষেপ নেয় — এটি শুধু ফারিয়ার মুক্তির প্রশ্ন নয়, এটি পুরো দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতেরও প্রশ্ন।