যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আরেকটি ভয়াবহ দিন যুক্ত হলো ৫ জুলাই। একদিকে যখন ক্যালিফোর্নিয়ার বিস্তীর্ণ বনভূমিতে ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের ভয়াবহ লেলিহান শিখা, অন্যদিকে তখনই টেক্সাসে আকস্মিক বন্যার পানিতে ভেসে গেছে একটি গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প। প্রাণ হারিয়েছেন বহু তরুণী—আরও অনেকেই এখনও নিখোঁজ। দেশজুড়ে চলছে শোক আর আতঙ্ক। এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের জলবায়ু খাতে বাজেট কমানোর সিদ্ধান্তে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার সান লুইস ওবিস্পো কাউন্টিতে ২ জুলাই শুরু হওয়া দাবানল—যা ‘মাদ্রে ফায়ার’ নামে পরিচিত—এখন রাজ্যের সবচেয়ে বড় দাবানলে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে ৭০,৮০০ একর বনভূমি ভস্মীভূত হয়েছে আগুনে। আগুন থামাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে ফায়ার সার্ভিস—৬০০ জনের বেশি কর্মী ও ৪০টির বেশি অগ্নিনির্বাপক ইঞ্জিন কাজে নিযুক্ত।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। শত শত বাড়িঘর আগুনের হুমকিতে। দুই শতাধিক মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। রাজ্যজুড়ে চরম সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
গভর্নর গ্যাভিন নিউসাম জানিয়েছেন, শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১৫ স্থানে আগুন দেখা দিয়েছে। আগের জানুয়ারিতেও ভয়াবহ আগুনে ৩০ জন প্রাণ হারিয়েছিল লস অ্যাঞ্জেলেসে। এবার আশঙ্কা করা হচ্ছে—এটি আরও বড় আকার নিতে পারে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল সোয়েইনের মতে, এই বছর দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় শীত ও বসন্ত ছিল অস্বাভাবিকভাবে শুষ্ক। ফলে গাছপালা ও আগাছা একেবারে শুকিয়ে যাওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
একই সময়ে, টেক্সাসের গুয়াদালুপে নদীতে আঘাত হানে আকস্মিক বন্যা। ৪ জুলাই মধ্যরাতে মাত্র ৪৫ মিনিটে নদীর পানি ২৬ ফুট বেড়ে ছাপিয়ে যায় দুই তীরের সামার ক্যাম্পগুলো। সেখানে উপস্থিত ছিল ৮০০ তরুণী ও কিশোরী শিক্ষার্থী। সবাই গ্রীষ্মকালীন স্কুল ক্যাম্পে অংশ নিতে গিয়েছিল।
ভোর ৪টায় যখন হড়কা বান আঘাত হানে, তখন প্রায় সবাই ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। ফলে অনেকেই নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। এখন পর্যন্ত ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, নিখোঁজ আরও অন্তত ২৫ জন।
টেক্সাস পুলিশের তথ্যে জানা যায়, পুরো ক্যাম্পটিই মেয়েদের জন্য নির্ধারিত ছিল। বন্যার পরে নদীর দুই তীরে চলমান উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছে ১৪টি হেলিকপ্টার, ১২টি ড্রোন, ৯টি রেসকিউ টিম এবং প্রায় ৫০০ সদস্য।
টেক্সাসের উপগভর্নর ড্যান প্যাট্রিক জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবিলায় নিয়োজিত ফেডারেল সংস্থাগুলোর বাজেট ও জনবল কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসাম তার বক্তব্যে বলেন,
“ট্রাম্পকে এখনই জেগে উঠতে হবে। তার অযোগ্যতা নাগরিকদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা এবং ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছে। গ্রীষ্মের মৌসুমে শুকনো আবহাওয়ার কারণে আগুনের ঝুঁকি, আর বর্ষাকালে হঠাৎ বন্যা—এই দুই বিপর্যয় যেন দেশজুড়ে স্থায়ী আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যদি পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ না করা হয়, তাহলে আগামীতে এসব দুর্যোগ আরও বড় আকার ধারণ করবে। আর তার বলি হবে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিশু-কিশোররা।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি কেবল একটি দুর্যোগপূর্ণ দিন নয়—বরং ভবিষ্যতের ভয়াবহ ইঙ্গিত। আগুন আর জলের এমন যুগপৎ আঘাত কেবল পরিবেশ নয়, নীতিনির্ধারকদেরও চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রশ্ন উঠছে—এখনো কি সময় হয়নি সত্যিই জেগে ওঠার?