বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক সময়ের জনপ্রিয় সংসদ সদস্য, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি সম্প্রতি এক বিস্ফোরক মন্তব্যে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তার ভাষায়, "গত এক বছরে আমরা বিরক্ত হয়ে গেছি।" সেই বিরক্তির পেছনে রয়েছে প্রতারণার মুখোশ পরা অনেক ‘নতুন দরবেশ’, ‘চাঁদাবাজ’ এবং ‘জালেম’-এর উত্থান, যারা ইতোমধ্যেই জনগণের চোখে তাদের সত্যিকার চেহারা উন্মোচন করে ফেলেছে।
রনি বলেন, “যারা বিগত ১৫ বছর হাউমাউ করে কেঁদেছেন, আমরা ভেবেছি তারা নির্যাতিত। আমরা তাদের জন্য দোয়া করেছি। ভেবেছি, এরা ফেরেশতার মতো মানুষ। কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর! এখন দেখছি, এরা ফেরেশতার ভাবমূর্তি থেকে দ্রুতই দানবের রূপ নিয়েছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “গত ১৫ বছরের দানবীয় তাণ্ডবও এই ১৫ দিনের ঘটনাপ্রবাহের কাছে ফিকে হয়ে গেছে। যারা নিজেদের নিপীড়িত বলে দাবি করতেন, তারাই এখন নিপীড়ক। যারা বিচার চেয়েছেন, তারাই এখন বিচারহীনতার প্রতীক হয়ে উঠছেন।
গোলাম মাওলা রনি দৃঢ়ভাবে বলেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে—সেসব বিপ্লবীদের হাতেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও আমরা একই দৃশ্য দেখছি। কারণ, এ দেশে সুনির্দিষ্ট কোনো নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি, দীর্ঘ প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে একটি বিপ্লব সংগঠিত হয়নি।”
তিনি দাবি করেন, জুলাই-আগস্টে যেটা ঘটেছিল, সেটা ছিল গণবিস্ফোরণ। “সেই সময় গৃহবধূ থেকে শিশুরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমেছিল। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিল এই আন্দোলনে। অথচ সেই সংগ্রামটিকে কেউ কেউ নিজেদের অর্জন হিসেবে দাবি করে কৃতিত্বের রাজনীতি শুরু করলেন।
তিনি বলেন, “যদি সম্মুখ নেতা বা ফ্রন্টলাইনাররা জনগণকে কৃতিত্ব দিতেন এবং অভিজ্ঞ নেতৃত্বের হাতে বিপ্লবের ফল তুলে দিতেন, তবে আজকে বিচার আরও গঠনমূলক হতো। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো থাকতো। কিন্তু এখন শুধু বিভ্রান্তি ও নিন্দাই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
১ জুলাই সকালে রাস্তায় বের হয়ে গোলাম মাওলা রনি মনে করেছিলেন, শাহবাগসহ ঢাকার রাজপথে উত্তাল জনতার ঢল দেখা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি বলেন, “সকাল ১১টা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করেছি। শাহবাগ এলাকায় একটি মানুষও ছিল না, ব্যানার তো দূরের কথা। এত বড় আন্দোলন, এত বড় সংগ্রাম, এত রক্ত—সবকিছু কি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া যায়?
তিনি তীব্র হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “আজকের দিনে আমি আশা করেছিলাম উত্তাল রাজপথ। কিন্তু পেয়েছি নীরবতা, নিরবচ্ছিন্ন নিরুত্তাপ একটা শহর।
রনির মতে, সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক বিষয় হচ্ছে—যাদের আমরা গত ১৫ বছর ধরে করুণার চোখে দেখেছি, তাদের আসল চেহারা এখন প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি বলেন, “এদের অনেকেই এখন নতুন ‘দরবেশ’, নতুন ‘জালেম’ আর নতুন চাঁদাবাজ। ১৫ বছরে যারা দানবের দুঃশাসন নিয়ে কাঁদছিলেন, তারাই ১৫ দিনের মধ্যে জনগণের সঙ্গে এমন আচরণ করেছেন যে, আগের জুলুমই যেন ছিল সহনশীল।
গোলাম মাওলা রনির বক্তব্য শুধু এক ব্যক্তির অভিমত নয়; এটি একটি জাতির হতাশার প্রতিচ্ছবি। যেখানে জনগণ ন্যায়বিচারের স্বপ্নে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু কিছু ‘নেতা’ সেই আশা-ভরসাকে দলীয় স্বার্থে, ব্যক্তিগত শক্তির খেলায় বিলীন করে দেন।
এই প্রশ্ন এখন সময়ের দাবি—আমরা কী সত্যিই বিপ্লব চেয়েছিলাম, নাকি স্রেফ ক্ষমতার মুখ পাল্টে দেখতে চেয়েছিলাম?



















