বিশ্বের অন্যতম রক্ষণশীল ইসলামী রাষ্ট্র সৌদি আরবের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ আসছে ২০২৬ সালের মধ্যেই। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য সান–এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশটির সরকার প্রথমবারের মতো ৬০০টি নির্দিষ্ট পর্যটন স্থানে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে অ্যালকোহল বিক্রির অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত সৌদি আরবের রাজকীয় পরিকল্পনা ‘ভিশন ২০৩০’-এর আওতায় নেওয়া হচ্ছে, যার মূল লক্ষ্য হলো দেশকে একটি আধুনিক, পর্যটনবান্ধব এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা।
পর্যটনের নামে নিয়ন্ত্রিত উদারতা
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, দেশটির ৫ তারকা হোটেল, বিলাসবহুল রিসোর্ট এবং প্রবাসীবান্ধব কম্পাউন্ডগুলোতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত পরিবেশে ওয়াইন, বিয়ার ও সাইডার বিক্রি অনুমোদিত হবে। তবে এ অনুমোদনের আওতা বাইরে থাকবে জনসাধারণের জায়গা, বাসা-বাড়ি, দোকান ও ফ্যান জোন।
এছাড়া দেশটি অ্যালকোহল সংক্রান্ত নীতিতে "কঠোর নিয়ন্ত্রিত কাঠামো" বজায় রাখবে বলে জানানো হয়েছে। লাইসেন্সধারী স্থানগুলোতে থাকবেন প্রশিক্ষিত কর্মী, কড়া তদারকি ও সংস্কৃতি রক্ষার সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন।
প্রতিদ্বন্দ্বী উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা
বিশ্ব পর্যটনের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলা দুবাই ও বাহরাইনের মতো দেশগুলো ইতিমধ্যেই তাদের পর্যটন অঞ্চলে অ্যালকোহল বৈধ করেছে। সৌদি আরব সেই পথে হেঁটে এবার প্রতিযোগিতায় সমানতালে টিকে থাকার কৌশল নিচ্ছে। বিশেষভাবে নিওম মেগাসিটি, সিন্দালাহ দ্বীপ ও রেড সি প্রকল্পে এ সুবিধা কার্যকর হবে।
দ্য সানের তথ্য অনুযায়ী, এই পরিবর্তন সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত নয়, বরং ‘আন্তর্জাতিক ভিজিটর’দের আকর্ষণের উদ্দেশ্যে একটি সীমিত সংস্কার। দেশটি এখন ‘পার্টি করতে প্রস্তুত’—কিন্তু সীমার মধ্যে থেকেই।
‘শুষ্ক’ ভাবমূর্তিতে ফাটল
এই পরিবর্তনের ঘোষণার আগে সৌদির উপ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন বন্দর যুক্তরাজ্যের এলবিসি রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘‘আমরা আমাদের সংস্কৃতির সীমানার মধ্যে থাকা মানুষকে আপন করে নিতে চাই, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি কাউকে খুশি করার জন্য পরিবর্তন করব না।’’
কিন্তু এই বক্তব্যে পশ্চিমা দেশগুলোর একাংশ ক্ষোভ প্রকাশ করে। বিশেষ করে, ২০৩৪ বিশ্বকাপে মদের সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় ইংল্যান্ডের ফুটবল ভক্তদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারই জবাবে বলা হচ্ছে, নতুন পরিকল্পনা সেই সমালোচনাকে ‘চুপ করিয়ে’ দেবে।
আইন ভাঙলে শাস্তি, সীমার বাইরে নয় উদারতা
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, মদের বিক্রি শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, লাইসেন্সধারী কর্মীদের মাধ্যমে, এবং অন্যায় ব্যবহারে কড়া শাস্তির আওতায় করা হবে।
সৌদি সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে –
-
২০% ABV (Alcohol by Volume) এর বেশি শক্তিশালী স্পিরিট নিষিদ্ধ থাকবে।
-
দোকান, হোম ডেলিভারি বা হোম ব্রিউইং এর কোনো সুযোগ থাকবে না।
-
যেকোনো আইন লঙ্ঘন করলে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সৌদি আধুনিকতা বনাম ঐতিহ্য – এক ভারসাম্য খোঁজা
বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি আরব একধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে, যেখানে তারা নিজেদের সাংস্কৃতিক মূলনীতি ধরে রেখে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তুলছে।
এই পরিকল্পনা ২০২৬ সালেই কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এটি হচ্ছে ২০৩৪ সালের বিশ্বকাপের ঠিক ৮ বছর আগে, যা আয়োজনের আগাম প্রস্তুতির ইঙ্গিতও বহন করছে।
সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন দেশটির সংস্কৃতিগত দৃঢ়তা বজায় রেখেছে, অন্যদিকে আধুনিক পর্যটন ও বৈশ্বিক ব্যবসার জন্য একটি নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। এই রূপান্তর নিঃসন্দেহে বিশ্ববাসীর নজর কাড়বে এবং সৌদিকে নতুন আলোয় দেখতে বাধ্য করবে।