দেশ স্বাধীন, মানুষ নয়: ৫৩ বছরের পরিক্রমায় স্বপ্নভঙ্গ ও বাস্তবতার মুখোমুখি বাংলাদেশ


১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ আজ ৫৩ বছরে পা দিয়েছে। তবু এই দীর্ঘ পথচলায় বারবার প্রশ্ন উঠেছে—স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে কি? দেশ স্বাধীন হলেও, দেশের মানুষের স্বাধীনতা আর স্বপ্নগুলো কি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়েছে?
মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা এই যুদ্ধ কোনো একক ঘটনা ছিল না। তবে আজ, ৫৩ বছর পর, অনেক প্রশ্নই এখনো ঘুরপাক খায়।
মুক্তিযুদ্ধ: আবেগ, রাজনীতি ও সত্যের অনুসন্ধান
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে গভীর আবেগ রয়েছে, কিন্তু সেই ইতিহাসের চর্চায় এসেছে নানা মতভেদ ও রাজনৈতিক বিকৃতি। একাত্তরকে ঘিরে চলেছে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের খেলা। ইতিহাসের সত্যকে তুলে আনা যেন এক বড় চ্যালেঞ্জ।
তখনকার পরিস্থিতি বিচার করলে দেখা যায়, পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা বাঙালির প্রতি বৈষম্যমূলক ছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সম্পদ পাচার করে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় করা হতো। এতে বাঙালিদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল গভীর ক্ষোভ। এ পরিস্থিতিতে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলন বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের চূড়ান্ত রূপ হয়ে দাঁড়ায়।
স্বপ্নভঙ্গের শুরু
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছয় দফার ভিত্তিতে বিজয়ী হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। এরপরই আসে ২৫ মার্চের ভয়াল রাত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর আক্রমণ বাঙালির সামনে স্বাধীনতার যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
যুদ্ধটি শুধু মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভারতীয় হস্তক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রভাব মুক্তিযুদ্ধকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়। ভারত নিজ স্বার্থে পাকিস্তানকে দুর্বল করতে বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিল এবং যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারতের সেনাবাহিনী সরাসরি অংশ নেয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়।
স্বাধীনতা অর্জন, কিন্তু কী হারাল বাঙালি?
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার। কিন্তু ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করে, যা জনআকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই শাসন অবসান হয়।
পরবর্তী কয়েক দশক ধরে দেশে গণতন্ত্রের নামে চলে ক্ষমতার রাজনীতি ও নির্বাচনব্যবস্থার অবক্ষয়। মানুষ বারবার প্রতারিত হয়েছে। দলীয় স্বার্থের কাছে জনগণের স্বপ্ন হারিয়ে গেছে। নির্বাচনের নামে ক্ষমতা দখলের খেলা চলতে থাকে।
আধিপত্যের শঙ্কা ও ভারতীয় প্রভাব
একাত্তরের যুদ্ধের পর ভারতের ভূমিকা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। ভারতের সীমান্ত খোলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা মুক্তিযুদ্ধকে সফল করলেও, ভারত তার স্বার্থ হাসিলে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তারে পিছপা হয়নি। আজও সেই প্রভাবের ছাপ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃশ্যমান।
স্বাধীন দেশে মানুষের পরাধীনতা
স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরেও আমরা একটি স্বচ্ছ নির্বাচনব্যবস্থা ও জবাবদিহিমূলক সরকার পাইনি। ক্ষমতাসীনদের হাতে গণতন্ত্র বারবার নির্বাসিত হয়েছে। রাজনৈতিক মাফিয়া চক্র জনগণের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের নামে চালু হয়েছে ফ্যাসিস্ট শাসন, যা স্বাধীনতার মূল চেতনা থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
স্বপ্নের বাংলাদেশ: কী চেয়েছিল মানুষ?
বাংলার মানুষ স্বাধীনতা চেয়েছিল বৈষম্যহীন, সুশাসনভিত্তিক একটি সমাজব্যবস্থা। মানুষ চেয়েছিল এমন একটি সরকার, যেখানে জনগণের প্রতিনিধি তাঁদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখবেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী পেয়েছি?
আমাদের গণতন্ত্র আজও প্রশ্নবিদ্ধ। দেশ স্বাধীন হলেও, সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত হয়নি। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এখনো রয়ে গেছে পূর্ণতার অপেক্ষায়।
উপসংহার: স্বাধীনতার সত্যিকার অর্থে মুক্তি কোথায়?
স্বাধীনতা মানে কেবল ভৌগোলিক মুক্তি নয়; এটি মানুষের অধিকার ও মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশ পেরিয়েছে ৫৩ বছর, কিন্তু আজও মানুষ সেই প্রতীক্ষায় আছে—কবে আসবে সত্যিকার স্বাধীনতা?
দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু মানুষ কি সত্যিই স্বাধীন? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে। সময় এসেছে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার চেতনা পুনরুদ্ধার করার, যেন বাঙালির স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস আর দীর্ঘায়িত না হয়।
कोई टिप्पणी नहीं मिली