close

কমেন্ট করুন পয়েন্ট জিতুন!

চট্টগ্রাম বন্দর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি কৌশলগত রূপান্তরের সন্ধিক্ষণ..

Bokhtiar Shamim avatar   
Bokhtiar Shamim
অর্থনৈতিক উত্তরণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন, স্বার্থ ও সম্ভাবনার সন্ধান

 

চট্টগ্রাম বন্দর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি কৌশলগত রূপান্তরের সন্ধিক্ষণ

অর্থনৈতিক উত্তরণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন, স্বার্থ ও সম্ভাবনার সন্ধান

 

বখতিয়ার শামীম

চট্টগ্রাম বন্দর—বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার, দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল এবং ভূরাজনৈতিকভাবে একটি অপ্রতিরোধ্য কৌশলগত অবস্থান। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বিশেষত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে, এই বন্দরের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উচ্চাভিলাষী এবং কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য—বাংলাদেশকে ২০৩৫ সালের মধ্যে একটি বৈশ্বিক উৎপাদন ও রপ্তানি কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা।

এই লক্ষ্যে, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা ছয় গুণ বাড়িয়ে বছরে ৭.৮৬ মিলিয়ন (TEU) কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ, বিদেশি বিনিয়োগে স্বচ্ছতা, জাতীয় স্বার্থরক্ষা এবং তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ২৫ বছরের নিচে, এবং এই বিশাল যুব জনগোষ্ঠীকে দক্ষ শ্রমবাজারে সংযুক্ত করা না গেলে তা সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে। ফলে চট্টগ্রামের উন্নয়ন শুধু অবকাঠামোগত নয়, একটি সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোরও অংশ।

চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নের বাস্তব সুফল এবং বিরোধের শিকড়

এই বন্দর উন্নয়নের মধ্য দিয়ে চারটি স্তরে সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে বৃহৎ সুবিধা তৈরি হবে:

১. জনগণ ও যুবসমাজ: শিল্প সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক গতি, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং মধ্যবিত্ত সম্প্রসারণ—সবকিছুই এই উন্নয়নের অংশীদার হবে।

২. বিনিয়োগকারী ও রপ্তানিকারক মহল: বিশ্বমানের অবকাঠামো, দ্রুত পণ্য পরিবহন, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা অর্জন এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ।

৩. আন্তর্জাতিক অংশীদার ও সংস্থা: চট্টগ্রামকে একটি দক্ষিণ এশীয় লজিস্টিক হাবে রূপান্তর, প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ, অপারেশনাল সহায়তা এবং জোটভিত্তিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার সুযোগ।

৪. সরকার ও রাষ্ট্র: রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি, কৌশলগত রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ়করণ, এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ।

তবে এই পথ নিছক মসৃণ নয়। দীর্ঘদিন ধরে বন্দরের চারপাশে গড়ে ওঠা 'অদৃশ্য অর্থনীতির' জাল, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতির সিন্ডিকেট এই উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা। যুগের পর যুগ ধরে ট্রাক মালিক, কাস্টমস কর্মকর্তা, শ্রমিক ইউনিয়ন, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনিক অংশীজনেরা বন্দরের অপারেশনে অনানুষ্ঠানিক অংশীদার হিসেবে নিজেদের জায়গা তৈরি করেছেন।

এই সিন্ডিকেট ভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানলে সচ্ছল রাজনৈতিক ফান্ডিং, অনিয়মতান্ত্রিক চাকরি বণ্টন এবং নির্বাচনী খরচের উৎস ক্ষীণ হয়ে যাবে—যা বহু রাজনীতিকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

রাজনৈতিক বাস্তবতা: উন্নয়নের নামে আশ্বাস না প্রতারণা?

এখানে প্রশ্ন ওঠে—চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন কি সত্যিই জনগণের কল্যাণে নাকি ক্ষমতার পুনর্বণ্টনকে ঘিরে লড়াইয়ের রূপ?

একদিকে, জনগণ যুগের পর যুগ শুনেছে মিষ্টি প্রতিশ্রুতি:

• বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার উৎপাদন কেন্দ্র।

• চট্টগ্রাম হবে বিশ্বমানের লজিস্টিক হাব।

• লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

এই প্রতিশ্রুতিগুলো যেন দইয়ের ঘোল—মুখে স্বাদ, পেটে শূন্যতা। বাস্তবে দেখা যায়, বন্দরের প্রতিটি স্তরে চাঁদাবাজি, দালালি, দীর্ঘসূত্রিতা এবং অপারেশনাল জটিলতা রয়েছে।

অনেকে বলছেন, জনগণকে মুখে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে পেছনে চুনের ঘোল খাওয়ানো হয়েছে—যা শুধু আস্থা ক্ষয় করে না, রাষ্ট্রের সম্ভাবনাও পুড়িয়ে দেয়। এই বাস্তবতা রাজনীতিকদের কাছেও স্পষ্ট, কিন্তু তারা চান না এই কাঠামো ভেঙে নতুন, স্বচ্ছ এক পদ্ধতি গড়ে উঠুক, যেখানে ক্ষমতা আর প্রভাব হবে নীতির ভিত্তিতে, পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়।

এছাড়া আন্তর্জাতিক কোম্পানির অংশগ্রহণ মানেই স্বচ্ছতা, নিরীক্ষা ও রিপোর্টিং—যা রাজনীতিকদের অনেকের কাছে রাজনৈতিক আত্মঘাতের সমান। কারণ, একবার এই গ্লোবাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি শুরু হলে ব্যক্তিগত ও দলীয় সুবিধা অর্জনের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ে।

বন্দর নয়, জাতির রূপান্তর

চট্টগ্রাম বন্দর এখন আর শুধুমাত্র একটি অবকাঠামো প্রকল্প নয়। এটি হচ্ছে একটি জাতীয় পরীক্ষার ক্ষেত্র—যেখানে দেশের নেতৃত্ব, নীতিশক্তি এবং ভবিষ্যতের দায়বদ্ধতা মূল্যায়িত হবে।

যদি এই উন্নয়ন কার্যক্রম স্বচ্ছতা, জাতীয় স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে পরিচালিত হয়, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের স্তম্ভ।

অন্যদিকে, যদি পুরনো খেলোয়াড়দের নিয়মেই বন্দরের আধুনিকায়ন পরিচালিত হয়—তবে এটি হবে আরেকটি সুযোগের অপচয়, আরেকটি দইয়ের ঘোলের গল্প।

এখন সময় এসেছে প্রশ্ন করার, চোখ খোলা রাখার, এবং উন্নয়নের ব্যানার নয়—বাস্তব কাজ দেখে মূল্যায়ন করার।

Không có bình luận nào được tìm thấy


News Card Generator