চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আহত সৈনিক ইমরান হোসাইন।
গাজীপুরে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত এই গার্মেন্টসকর্মী দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক যন্ত্রণা সয়ে চলছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই যন্ত্রণাই তার জীবনের ইতি টেনে দেয়। শনিবার (১৪ জুন) ভোররাতে গাজীপুরের নিজ বাসায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৩০ বছর।
ইমরান ছিলেন ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মুশুল্লী ইউনিয়নের চপই মোহনপুর গ্রামের বাসিন্দা। স্থানীয়ভাবে শান্ত স্বভাবের ও পরিশ্রমী হিসেবে পরিচিত এই যুবক ছিলেন গার্মেন্টস খাতের একজন শ্রমিক। জীবনের অনিশ্চয়তা, দারিদ্র্য ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই তিনি অংশ নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’-এ।
তবে তার সেই সাহসী অংশগ্রহণই হয়ে উঠেছিল তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায়।
জুলাইয়ের রক্তাক্ত দুপুর
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আন্দোলনের এক পর্যায়ে গাজীপুরে বিক্ষোভ চলাকালে হঠাৎ করেই পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি চালায়। ওই সময়ই ইমরান পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহত হন। দ্রুত তাকে কাছাকাছি একটি স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হলেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেয়ে পরে বাসায় ফিরিয়ে আনতে হয়।
এরপর কেটে যায় প্রায় এক মাস। তার শারীরিক অবস্থার ক্রমাবনতি হলেও চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না তার পরিবারের। ফলে বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যু তাকে গ্রাস করে।
শূন্যতা আর কান্নায় ভেসে গেল চপই মোহনপুর গ্রাম
ইমরানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার মরদেহ শনিবার দুপুর ২টায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। উপস্থিত ছিলেন আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও স্থানীয় অনেক মানুষ। চারপাশে শুধু একটাই শব্দ—“ইমরান ন্যায্য অধিকার চাইতে গিয়ে জীবন দিল, কিন্তু বেঁচে থাকার অধিকার পেল না।”
তিনি স্ত্রী ও একটি ছোট শিশুসন্তান রেখে গেছেন, যাদের এখন জীবনযুদ্ধ চালাতে হবে ইমরান ছাড়া।
নেতাদের শোক, কিন্তু সহায়তার অনুপস্থিতি
ইমরানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর কেন্দ্রীয় মুখ্য সমন্বয়ক আশিকিন আলম রাজন এবং এনসিপি নান্দাইল উপজেলা শাখার আহ্বায়ক সোলায়মান হাকিম বুলবুল। তারা বলেন, “ইমরানের মতো সাহসী যুবকের মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সরকার ও সমাজকে তার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে।”
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এমন শোক বার্তার বাইরে কি কেউ ইমরানের পরিবারের পাশে বাস্তবে দাঁড়াবে?
ইমরানের মৃত্যু কেবল একটি ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়—এটি আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি একটি তীব্র প্রশ্নবাণ। একজন আন্দোলনকারী আহত হলো পুলিশের গুলিতে, এরপর যথাযথ চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হলো—এই চিত্র বলে দেয় এই সমাজে দরিদ্রের জীবনের মূল্য কতটা কম।
যাদের কণ্ঠে আমরা প্রতিবাদের আশা করি, যাদের কাছ থেকে সহায়তার আশ্বাস পাওয়ার কথা, তাদের নিস্পৃহতা এই মৃত্যুতে আরও হৃদয়বিদারক করে তুলেছে।