ছদ্মবেশে জনরোষ এড়ানোর নাটকীয় কাহিনি : আবদুল হামিদের রহস্যময় দেশত্যাগ
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন জল্পনা-কল্পনা। বুধবার গভীর রাতে তিনি সম্পূর্ণ ছদ্মবেশে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। লুঙ্গি, গেঞ্জি ও মুখে মাস্ক পরে ভিআইপি টার্মিনালে প্রবেশ করেন তিনি। দেশজুড়ে চলমান উত্তেজনা ও জনরোষের প্রেক্ষাপটে তার এই গোপন দেশত্যাগ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বুধবার রাত ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে আবদুল হামিদের ব্যক্তিগত গাড়িটি ঢোকে ভিআইপি টার্মিনালে। গাড়ি থামানো হয় নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে। চালক পরিচয় দেন—গাড়িতে সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবার রয়েছে। সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গাড়িটি অপেক্ষা করবে। এরপর শুরু হয় একের পর এক নাটকীয়তা।
এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, ক্লিয়ারেন্স যাচাই করতে গিয়ে এক পর্যায়ে গোয়েন্দা সংস্থার একজন সদস্য তড়িঘড়ি করে সেখানে উপস্থিত হন এবং জানিয়ে দেন, সাবেক রাষ্ট্রপতির বহির্গমন অনুমোদন রয়েছে। তখন তাকে বিমানবন্দরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।
গাড়িতেই পোশাক বদলে ফেলেন আবদুল হামিদ। সাধারণ মানুষের চোখে যেন ধরা না পড়েন, তাই লুঙ্গি-গেঞ্জি ছেড়ে পরে নেন শার্ট ও প্যান্ট। এরপর ডিএসও (ডেপুটি সিকিউরিটি অফিসার)-এর কক্ষে তাকে কিছু সময় রাখা হয়। সেখানে সিভিল এভিয়েশন ও এভসেক-এর (বিমানবন্দর নিরাপত্তা বাহিনী) কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন।
একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে ফোনালাপের পর সবুজ সংকেত মেলে এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কঠোর গোপনীয়তায় তাকে বিমানবন্দরের ১২ নম্বর আউট-বেতে নেওয়া হয়। থাই এয়ারওয়েজের টিজি৩৪০ নম্বর ফ্লাইটে ওঠার আগ পর্যন্ত তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
বিমান ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই তার ছেলে রিয়াদ আহমেদ এবং শ্যালক ডা. এনএম নওশাদ খান বিমানে ওঠার অনুমতি পান। তাদের হাতে ছিল সাধারণ পাসপোর্ট, তবে আবদুল হামিদ কূটনৈতিক মর্যাদার বিশেষ লাল পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। এই পাসপোর্টটি ইস্যু হয়েছিল ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি, যার মেয়াদ রয়েছে ২০৩০ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত।
কিন্তু এখানেই জন্ম নেয় বড় প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যের লাল পাসপোর্ট ইতোমধ্যে বাতিল হলেও, আবদুল হামিদের পাসপোর্ট এখনও বহাল রয়েছে। কেন তাকে ছাড় দেওয়া হলো, তা নিয়েই তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, সাবেক রাষ্ট্রপতিরা আমৃত্যু বিচারপতির মর্যাদা পান, ফলে আইনগতভাবে লাল পাসপোর্ট বাতিলের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেকেই মনে করছেন, সরকার ইচ্ছা করলে বিশেষ নির্দেশনা দিতে পারত, যা করা হয়নি।
একইসঙ্গে জানা গেছে, ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়াও স্বাভাবিক নিয়মে সম্পন্ন হয়নি। অনেক কর্মকর্তাই ছিলেন গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে, তাই আবদুল হামিদকে জনসমক্ষে না এনে গোপনে বিমানে তুলে দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, ব্যাংককগামী ফ্লাইটে তার গন্তব্য দেখানো হলেও প্রকৃত গন্তব্য দিল্লি পর্যন্ত নিশ্চিত করা গেছে। তবে ১৬ জুনে দেশে ফেরার টিকিটও রয়েছে তার নামে।
এই পুরো পরিকল্পনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সিভিল এভিয়েশন, এবং গোয়েন্দা সংস্থার নিরব উপস্থিতি, বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহে তৃতীয় পক্ষের ব্যবহার এবং ইমিগ্রেশন পাসিংয়ের বিষয়ে নীরবতা—সব মিলিয়ে দেশের রাজনীতিতে এই দেশত্যাগের ঘটনা যেন এক নতুন রহস্যকাব্য।
শেষ কথা:
আবদুল হামিদ কী কেবল নিরাপত্তার কারণেই ছদ্মবেশে দেশ ছেড়েছেন, নাকি এর পেছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক সমঝোতা—তা সময়ই বলে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত যা দেখা গেছে, তাতে জনগণের মনে সন্দেহ ও প্রশ্ন আরও ঘনীভূত হচ্ছে।