close

কমেন্ট করুন পয়েন্ট জিতুন!

বিষণ্ণতা (ডিপ্রেশন) থেকে মুক্তির উপায়: একটি জরুরি আলোচনা

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন একদিকে যেমন একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, তেমনি এটি এখন পৃথিবীজুড়ে এক বৃহত্তর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবেও পরিগণিত হচ্
বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন একদিকে যেমন একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, তেমনি এটি এখন পৃথিবীজুড়ে এক বৃহত্তর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবেও পরিগণিত হচ্ছে। এ সমস্যা শুধু ব্যক্তির মানসিক অবস্থা নয়, এর প্রভাব পড়ে তার পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, ডিপ্রেশন বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে সাধারণ মানসিক রোগ এবং প্রতি বছর এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে মানবিক দুঃখ-কষ্টের পাশাপাশি, বেশ কিছু শারীরিক সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। তবে এই বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ রয়েছে। ডিপ্রেশন মোকাবেলায় বিভিন্ন চিকিৎসা, মানসিক সহায়তা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই নিবন্ধে আমরা বিষণ্ণতা থেকে মুক্তির উপায়গুলোর বিস্তারিত আলোচনা করবো, যা শুধু চিকিৎসকরা নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতাও প্রমাণ করে। ১. বিষণ্ণতার প্রকৃতি ও ইতিহাস ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে মানুষ অবচেতনভাবে হতাশা, শূন্যতা এবং আগ্রহের অভাব অনুভব করে। এটি একদিকে যেমন অনুকূল পরিবেশের অভাবে হতে পারে, তেমনি জীবনযাত্রার বিভিন্ন চাপ, ব্যক্তিগত বিপর্যয়, কিংবা জেনেটিক বা রাসায়নিক অমিলের কারণে হতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী, বিষণ্ণতার লক্ষণগুলো ব্যক্তির মনের গভীরে শিকড় গেড়ে বসে এবং এটি ধীরে ধীরে তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। অতীতকালেও বিষণ্ণতা ছিল একটি পরিচিত সমস্যা, তবে তখন এটি চিহ্নিত করা, চিকিৎসা করা এবং আলোচনা করা সহজ ছিল না। ধীরে ধীরে ২০শ শতাব্দীর শেষে এবং ২১শ শতাব্দীতে এটি বিষয়টি মূলধারায় আসে। বিশেষ করে মনোরোগ চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি, যেমন সাইকোথেরাপি এবং ঔষধের মাধ্যমে, বিষণ্ণতা নিরাময় বা এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ তৈরি হতে থাকে। ২. বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রভাব বিশ্বব্যাপী বিষণ্ণতার প্রবণতা বাড়ছে। ২০১৯ সালের একটি WHO প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ২৮০ মিলিয়ন মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে, এবং এর মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই শারীরিক বা মানসিকভাবে এর প্রভাব অনুভব করছে। বাংলাদেশেও এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ১০-১৫% মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে, যাদের মধ্যে তরুণ সমাজের সংখ্যা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানসিক চাপ, সামাজিক চাহিদা, এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এই সমস্যা বৃদ্ধি করছে। এই প্রবণতা নানা কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রথমত, প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবের কারণে মানুষের মধ্যে তুলনামূলক বেশি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জীবনযাত্রার স্তর বৃদ্ধি, কর্মজীবনে প্রতিযোগিতা এবং সামাজিক সম্পর্কের টানাপোড়েনও এই সমস্যাকে প্রকট করে তুলেছে। ৩. বিষণ্ণতা থেকে মুক্তির উপায় বিষণ্ণতা মোকাবেলার ক্ষেত্রে অনেক উপায় রয়েছে। তবে, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত সমাধান আলাদা হতে পারে। এখানে কিছু প্রধান উপায় উল্লেখ করা হলো: ৩.১. চিকিৎসা ও মনোবিজ্ঞানী পরামর্শ ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির জন্য প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো পেশাদার চিকিৎসকের সহায়তা নেওয়া। একজন মনোবিজ্ঞানী বা সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্যে ডিপ্রেশন নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসা সম্ভব। থেরাপি (Therapy): সাইকোথেরাপি, বিশেষ করে কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT), বিষণ্ণতা দূর করার একটি কার্যকরী উপায়। এই থেরাপি রোগীকে তার নেতিবাচক চিন্তা এবং আচরণের পরিবর্তন করতে সহায়তা করে। ঔষধ (Medication): অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যদি ডিপ্রেশন গম্ভীর হয়, ঔষধ সেবন প্রয়োজন হয়। অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট মেডিসিন যেমন SSRI (Selective Serotonin Reuptake Inhibitors) বিষণ্ণতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। ৩.২. শরীরচর্চা শরীরচর্চা বিষণ্ণতা নিরাময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত ব্যায়াম সেরোটোনিন ও ডোপামিন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা আমাদের মস্তিষ্কে সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করে। কিছু সাধারণ ব্যায়াম যেমন হাঁটাচলা, দৌড়ানো, যোগব্যায়াম, এবং সাঁতার কাটাও মনকে শান্ত রাখতে সহায়তা করে। ৩.৩. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ভালো ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, এবং নেশাজাতীয় দ্রব্যের পরিহার বিষণ্ণতা থেকে মুক্তির গুরুত্বপূর্ণ উপায়। অপর্যাপ্ত ঘুম এবং অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস বিষণ্ণতার লক্ষণকে বাড়িয়ে দিতে পারে। পরিপূর্ণ বিশ্রাম এবং পুষ্টিকর খাবারের অভ্যাস বিষণ্ণতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি বৃদ্ধি করে। ৩.৪. সমর্থনমূলক পরিবেশ ও সম্পর্ক বিষণ্ণতা অনেক সময় একাকীত্ব বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ফলেও সৃষ্টি হয়। একজন ব্যক্তি যখন তার পরিবার, বন্ধু বা সহকর্মীদের কাছ থেকে সহানুভূতি এবং সমর্থন পায়, তখন তার মানসিক অবস্থা অনেক ভালো হতে পারে। অপরদিকে, সামাজিক সম্পর্কের অবনতি এবং একাকীত্ব বিষণ্ণতার লক্ষণকে তীব্র করতে পারে। এই কারণে, একজন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের জন্য একটি সমর্থনমূলক সামাজিক পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। ৩.৫. ধ্যান ও মানসিক প্রশান্তি ধ্যান বা মেডিটেশন বিষণ্ণতা থেকে মুক্তির একটি শক্তিশালী উপায়। এটি মানুষের মনকে শান্ত করে এবং শরীরের স্ট্রেস হরমোন কমাতে সহায়তা করে। প্রাচীন ভারতীয় যোগব্যায়াম বা mindfulness মেডিটেশন বিষণ্ণতা নিরাময়ে বিশেষভাবে উপকারী। ৩.৬. সৃজনশীল কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা এবং শখের কাজগুলোও মানুষের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। গানের সাধনা, ছবি আঁকা, লেখালেখি, বা যে কোন সৃজনশীল কাজ মানুষকে মানসিকভাবে প্রশান্তি প্রদান করে এবং বিষণ্ণতার পরিমাণ কমায়। ৪. বিষণ্ণতা মোকাবেলায় সমাজ ও সরকারের ভূমিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা বরাবরই ডিপ্রেশন নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। বাংলাদেশের সরকারও ইতোমধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে, আরও বিস্তৃত ও কার্যকর উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা অফিস ও কর্মস্থলে মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এই ধরনের উদ্যোগ বিষণ্ণতা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।বিষণ্ণতা, যদিও একটি মানসিক সমস্যা, কিন্তু এটি একেবারে নিরাময়যোগ্য। উপযুক্ত চিকিৎসা, সচেতনতা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন দ্বারা একজন মানুষ বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পেতে পারে। তবে, এটি সমাজের সকল স্তরের একটি দায়িত্ব। একে শুধুমাত্র চিকিৎসা বিষয় হিসেবে না দেখে একটি সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে, যাতে প্রতিটি মানুষকে সহায়তা করা যায়। ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় শুধু চিকিৎসা নয়, বরং পারিবারিক, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক সহায়তাও জরুরি। এই জন্য, সমগ্র সমাজকেই একসাথে কাজ করতে হবে, যাতে বিষণ্ণতা থেকে মুক্তির পথ আরও সুগম হয়।
No comments found


News Card Generator