বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যৌনসম্পর্ক স্থাপনকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করার প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে এবার হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়েছে।
এই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সোমবার (৭ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. রাশিদুল হাসান ও মানবাধিকার সংগঠন 'এইড ফর ম্যান ফাউন্ডেশন'-এর পক্ষে আইনজীবী ইশরাত হাসান একটি রিট আবেদন দাখিল করেন। এই রিটে আইনটি কেন বেআইনি, অসাংবিধানিক ও বাতিলযোগ্য ঘোষণা করা হবে না—তা জানতে চেয়ে আদালতের কাছে রুল জারির আবেদন জানানো হয়েছে।
রিট আবেদনকারী আইনজীবী ইশরাত হাসান জানান, হাইকোর্টের বিচারপতি রাজিক আল জলিল এবং বিচারপতি তামান্না রহমান খালেদীর সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চে এই রিটের শুনানি হবে। রিটে বিবাদী করা হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব এবং নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে।
রিটের মূল যুক্তি:
রিটে উল্লেখ করা হয়, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ যদি পারস্পরিক সম্মতিতে যৌনসম্পর্কে জড়ান, শুধুমাত্র বিয়ের প্রতিশ্রুতি রাখেননি বলে সেই সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা সংবিধানসম্মত নয়। এটি ব্যক্তি স্বাধীনতা, সম্মতির অধিকার এবং নারীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার পরিপন্থি।
এছাড়া রিটে আরও বলা হয়, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্পর্ক স্থাপনের পর যদি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা না-ও হয়, তবুও এমন অভিযোগের ভিত্তিতে পুরুষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হলে তা সংবিধানের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে। এটি পক্ষপাতদুষ্ট, একতরফা ও ন্যায়বিচার পরিপন্থি।
রিট আবেদনকারীরা মত প্রকাশ করেছেন, এই ধরণের আইন নারীকে দুর্বল ও লোভী চরিত্রে চিত্রায়িত করে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর সম্মতিসহকৃত সিদ্ধান্তকে অসম্মান জানানো হয়, যা আধুনিক সমাজের নারী স্বাধীনতার মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সংবিধান ও নাগরিক অধিকার প্রসঙ্গে রিটকারীর বক্তব্য:
আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, “এটি একটি নাগরিক অধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থি আইন। এখানে নারীর মতামত, স্বাধীন ইচ্ছা এবং যৌন স্বাধীনতাকে নাকচ করে দেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র একজন পুরুষ পরবর্তীতে বিয়ে করেননি বলেই। এটি এক ধরনের জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য।”
তিনি আরও বলেন, “কোনো নারীর সম্মতিসহ যৌনসম্পর্ক স্থাপন যদি অপরাধ হয় শুধুমাত্র বিয়ের প্রতিশ্রুতি না রাখার জন্য, তবে সেটা মূলত ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। এমনকি এটি আইনের অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে।”
এই আইন কেন বিতর্কিত?
আলোচ্য আইনের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো—এই আইনের মাধ্যমে নারীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকে ‘নির্বোধ’ বা ‘দৃষ্টিভ্রান্ত’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়। নারীর সম্মতি থাকলেও সম্পর্ক স্থাপনের দায় পুরুষের কাঁধেই চাপিয়ে দেওয়া হয়, যা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই একধরনের অবমাননা ও আইনি ঝুঁকি তৈরি করে।
সম্ভাব্য প্রভাব:
এই রিটের মাধ্যমে যদি হাইকোর্ট প্রচলিত আইনটির বৈধতা বাতিল করে দেয়, তাহলে তা হবে নারী-পুরুষ উভয়ের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পক্ষে এক যুগান্তকারী রায়। তবে এ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে, কারণ অনেকে মনে করেন—বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করে যৌনসম্পর্ক করা নৈতিকভাবে অপরাধ, এবং এতে নারীরা প্রতারিত হন।
এই রিট শুধুমাত্র একটি আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ নয়—এটি বাংলাদেশের সামাজিক রীতি, আইনি দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে এক নতুন আলোচনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এখন দেখার বিষয়, হাইকোর্ট এই রিটে কী রায় দেন এবং তা বাংলাদেশের আইনি ও সামাজিক ব্যবস্থায় কী ধরনের প্রভাব ফেলে।