নির্বাচন ঘিরে ইসলামী রাজনৈতিক শক্তির জোট বাঁধা — কৌশলগত প্রতিপক্ষ বিএনপি!
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ এখনো নির্ধারিত না হলেও মাঠে ইতোমধ্যেই বেশ জোরালো তৎপরতা চালাচ্ছে দেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন কমিশন কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা আসেনি, কিন্তু ইসলামী দলগুলো যেন নিজেদের লক্ষ্যে অটল। বড় পরিসরে ইসলামী ঐক্য গঠন, ভোট একত্রিকরণ এবং বৃহৎ নির্বাচনী কৌশল বাস্তবায়নে তারা একজোট হয়ে কাজ করছে।
বিশেষ করে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি ও খেলাফত মজলিস—এই পাঁচটি ইসলামী দল ইতোমধ্যে এক বাক্সে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। লক্ষ্য একটাই: নির্বাচনী মাঠে নিজেদের প্রভাব নিশ্চিত করা এবং বিএনপির মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা।
ইসলামী ঐক্য গঠনের রূপরেখা:
সম্প্রতি রাজধানীর পল্টনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই পাঁচ দলের শীর্ষ নেতারা একত্রিত হন। বৈঠকে দলগুলোর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা হয় যে, তারা ভোটে একই প্রতীক বা জোটীয় রূপে অংশ নেবেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিম (চরমোনাই পীর), যিনি বলেন, “এখন সময় এসেছে এক বাক্সে ভোট পাঠানোর। ইসলামী শক্তি আর ছিন্নভিন্ন হয়ে থাকবে না।”
তবে এখানেই থেমে নেই পরিকল্পনা। এই জোটে আরও ইসলামী দলকে যুক্ত করার চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত আন্দোলন—এই দুই দলকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে, যদিও কিছু জটিলতা রয়েছে।
সূত্রমতে, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আব্দুল হাসনাত আমিনী এবং মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহকে এই নতুন ঐক্য থেকে আপাতত বাদ রাখা হয়েছে।
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর অবস্থান:
হেফাজতে ইসলাম ঘনিষ্ঠ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোও একধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ৫ আগস্টের পর থেকে এই দলগুলো একাধিক ফোরামে ঘোষণা দিয়েছে যে, আগামী নির্বাচনে তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকবে “ইসলামী ভোট একত্র করা”।
এই ধারার পৃষ্ঠপোষকতায় গত ১৭ এপ্রিল ফের বৈঠকে বসে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি। ঐক্য সংহত করার এই পদক্ষেপের সঙ্গে দ্রুত যুক্ত হয় চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
জামায়াত ও চরমোনাইয়ের পুনর্মিলন:
একসময় আদর্শগতভাবে দূরে থাকা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে চরমোনাই পীরের সংলাপও এবার ঐক্যপ্রয়াসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ২১ জানুয়ারি জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান এবং ইসলামী আন্দোলনের আমির রেজাউল করিমের মধ্যে সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এমনকি জামায়াতের আমির ২৯ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা দেন, “ইসলামী দলগুলোর মাথায় আর কেউ কাঁঠাল ভেঙে খেতে পারবে না।” তার এই বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
বিএনপি দ্বিধায়:
বিএনপির অনেক নেতাই এই ঐক্যকে "স্বাধীনতাবিরোধীদের মিলনমেলা" এবং "ফ্যাসিবাদীদের সহযোগী জোট" হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তবে বাস্তব রাজনীতির চাপে পড়ে দলটি আবারও নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করছে।
ঐ বৈঠকের পাঁচ দিন পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চরমোনাই পীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে দুই পক্ষের মধ্যে ন্যূনতম রাজনৈতিক সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে ১০ দফা চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়।
বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন:
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসলামী দলগুলোর মধ্যে এই ধরনের ঐক্যবদ্ধতা আগামী নির্বাচনে একটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করবে। একদিকে তারা বিএনপির ভোটব্যাংকে ভাগ বসাতে পারে, অন্যদিকে কোনো সমঝোতার মাধ্যমে জোটে জায়গা করে নিয়ে আসনও আদায় করে নিতে পারে।
বর্তমানে ১২ দলীয় জোটের অনেক নেতাই জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রাখছে এবং প্রায় প্রতিটি বিষয়ে বিএনপির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। একে রাজনৈতিক সমীকরণে ইসলামী শিবিরের অভূতপূর্ব সক্রিয়তা হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা।