ফরিদপুরে সরকারি অর্পিত সম্পত্তি দখলের চেষ্টায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেত্রী ও সাবেক সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ঝর্ণা হাসানকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে, ভারতীয় এক নাগরিককে ব্যবহার করে তিনি জমির প্রকৃত মালিকদের উচ্ছেদে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। প্রশাসন নীরব, আর ভুক্তভোগীরা বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন আদালতে।
বিদেশিকে সাজিয়ে দখলের নীলনকশা
ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ আলীপুরের ২২ শতাংশ জমি মূলত অর্পিত সম্পত্তি। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে মালিক দীনেশ চন্দ্র সমাদ্দার ভারতে চলে যাওয়ার পর এই জমি সরকারের মালিকানায় আসে। বহু বছর ধরে সেখানে বাস করছেন অচিন্ত কুমার চক্রবর্তী, দিলীপ কুমার চক্রবর্তীসহ সংখ্যালঘু কয়েকটি পরিবার। সরকার নিজেই তাদেরকে এই জমির উপর লীজ প্রদান করে, যার প্রমাণ রয়েছে রেকর্ড ও খাজনা রশিদের মধ্যেই।
কিন্তু অভিযোগ বলছে, মৃত পৌরসভার চেয়ারম্যান হাসিবুল হাসান লাভলুর স্ত্রী ঝর্ণা হাসান সেই জমি দখলের উদ্দেশ্যে ননীবালা দেবীর নামে রেকর্ড করিয়ে পরবর্তীতে তার ‘ভুয়া ওয়ারিশ’ সাজিয়ে ভারতীয় নাগরিক বীরেশ চন্দ্র চক্রবর্তীর মাধ্যমে জমির মালিকানা দাবি করেন। কাগজপত্র গায়েব, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বানানো ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ভুল তথ্য দিয়ে ম্যানুপুলেট করাই ছিল তাদের পরিকল্পনার অংশ।
আদালতে মামলা, তবু প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা
ফরিদপুর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে করা মামলায় বিবাদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে জেলা প্রশাসক, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, পৌরসভার তহশিলদারসহ ভারতীয় নাগরিক বীরেশ চন্দ্র চক্রবর্তীকে। বাদীরা দাবি করেন, বীরেশ যেন এই সম্পত্তি বিক্রি করে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে কারণে আদালতের কাছে স্থগিতাদেশও চাওয়া হয়েছে। কিন্তু ৪টি ধার্য তারিখ অতিক্রম করলেও আদালতের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।
হুমকি, ভয়, আর উৎখাতের আশঙ্কা
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, বর্তমানে ঝর্ণা হাসান ও তার সহযোগীরা জমিটি দখল নিতে ক্রেতাদের দেখাচ্ছেন, ভরাট করছেন এবং ভুক্তভোগী সংখ্যালঘু পরিবারগুলিকে সরাসরি হুমকি দিচ্ছেন। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে বসবাস করা এই পরিবারগুলো চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে।
এক বাদী অভিযোগ করেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগসাজশে মোটা অংকের বিনিময়ে বীরেশের নামে জমির নামজারি করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় নাকি স্থানীয় প্রেসক্লাব সভাপতিও যুক্ত রয়েছেন।
দুদকের রিপোর্টও জানায় অনিয়মের চিত্র
২০১৫ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, উল্লেখিত জমিটি প্রকৃতপক্ষে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে এবং লাভলুর নামে জরিপ রেকর্ডটি অবৈধ। যদিও রিপোর্টে ‘ভেস্টেট প্রপার্টি’ বলা হলেও তা কখনো সরকারিভাবে গেজেটভুক্ত হয়নি।
পলাতক থেকেও প্রভাব খাটানোর অভিযোগ
২০২৩ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ঝর্ণা হাসান পলাতক। কিন্তু তিনি এখনও জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা ব্যবহার করে জমি দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে ভুক্তভোগীদের দাবি। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কার্যক্রম নিয়ে।
সরকারের সম্পত্তি কারা রক্ষা করবে?
ফরিদপুরে সরকারি সম্পত্তি দখলের এই ঘটনা শুধু স্থানীয় কোনো সমস্যার প্রতিফলন নয়, বরং পুরো দেশের আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। প্রশাসনের নীরবতা, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং দুর্নীতির জাল মিলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? প্রশ্নটি এখন শুধু ফরিদপুর নয়, গোটা দেশের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে।