চীনের দ্রুত বাঁধ নির্মাণে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানো: ভারতের হুমকির পাল্টা জবাব?
পানির ওপর ভর করে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে উপমহাদেশের ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক। ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানে পানি সরবরাহ বন্ধের হুমকি আসার পরপরই চীন কার্যত শক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে নির্মাণাধীন মোহমান্দ বাঁধ প্রকল্পে নতুন করে গতি এনেছে দেশটি। এই পদক্ষেপ একদিকে যেমন পাকিস্তানের পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে ভারতের হুমকির জবাবে একটি কৌশলগত বার্তা হিসেবেও এটি বিবেচিত হচ্ছে।
চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিসিটিভি-তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের পেহেলগাম ঘটনার পর দেশটি বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি চুক্তি সাময়িকভাবে স্থগিত করে। এরপরই চীন মোহমান্দ হাইড্রো পাওয়ার প্রকল্পের নির্মাণকাজে গতি বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এটি শুধু প্রতিক্রিয়ামূলক কোনো পদক্ষেপ নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ।
মোহমান্দ বাঁধ: একাধিক উদ্দেশ্যের মহাপরিকল্পনা
চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান চায়না এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন ২০১৯ সাল থেকে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে মোহমান্দ হাইড্রো পাওয়ার প্রকল্পে কাজ করছে। বর্তমানে তারা বাঁধের কংক্রিট ভরাটের কাজ শুরু করেছে, যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি সম্পন্ন করা যায়।
এই বাঁধ একটি বহুমুখী প্রকল্প। একদিকে এটি ৮০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, অন্যদিকে এর মাধ্যমে প্রতিদিন ৩০ কোটি গ্যালন পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে খাইবার পাখতুনখোয়ার রাজধানী পেশোয়ারে। পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষিকাজে সেচ ব্যবস্থাও নিশ্চিত করবে এই প্রকল্প।
এমন একটি সময় যখন পানির জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লড়াই শুরু হয়েছে, তখন মোহমান্দ বাঁধ পাকিস্তানের জন্য শুধু একটি অবকাঠামো নয়, বরং জল নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে উঠছে।
চীন-পাকিস্তান জোটের আরও বহু পরিকল্পনা
এই বাঁধ প্রকল্প চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) এর অংশ। এটি এমন এক বৃহৎ অর্থনৈতিক উদ্যোগ যার মাধ্যমে পাকিস্তানে শিল্প, কৃষি ও জীবনমান উন্নয়নে বহু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। চীন এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় তার কৌশলগত প্রভাব আরও সুসংহত করতে চাইছে।
এর বাইরেও রয়েছে দিয়ামার-ভাশা বাঁধ, যা পাকিস্তানে “থ্রি গর্জেস” প্রকল্প নামে পরিচিত। বিশালাকৃতির এই প্রকল্পও চীন-পাকিস্তান যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলা হচ্ছে। এটি কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রেই নয়, বরং ভবিষ্যতের পানির কূটনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ভারত কী করবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করা ছিল একটি কঠিন বার্তা, কিন্তু এর পাল্টা জবাবে চীন ও পাকিস্তানের যৌথ পদক্ষেপ আরও বৃহৎ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ক্রমেই জলবায়ু ও পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
পানিকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়, তবে চীনের এই সরাসরি অংশগ্রহণ পরিস্থিতিকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। ভারতের জন্য এটি শুধু সীমান্ত বিষয়ক কূটনীতি নয়, বরং অঞ্চলজুড়ে জলসম্পদ ও ভৌগলিক আধিপত্য নিয়েও একটি নতুন চ্যালেঞ্জ।
মোহমান্দ বাঁধ এখন আর শুধু একটি নির্মাণ প্রকল্প নয়; এটি হয়ে উঠছে একটি প্রতিরোধের প্রতীক, কৌশলগত বার্তা ও আঞ্চলিক শক্তির পরিমাপক। ভারত যদি পানির ‘হুমকি’ দিয়ে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে চীন ও পাকিস্তানের এই জলবাঁধ হয়ে উঠতে পারে একটি শক্ত জবাব।