জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে ভারতের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে—এমনই বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছেন চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি একরামুল করিম। চট্টেশ্বরী এলাকায় নিজ বাসভবনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই বর্ষীয়ান বিএনপি নেতা দাবি করেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার কঠোর দেশপ্রেম, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে ভারতের আগ্রাসনের বিরোধিতা এবং পাহাড়ে ভারতপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান—এইসবই ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র)-এর চক্ষুশূল।
৭২ বছর বয়সী এই নেতা বলেন, “জিয়াউর রহমান ছিলেন এক নির্ভীক দেশপ্রেমিক। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশ একটি পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠুক, যেখানে কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ থাকবে না। কিন্তু ভারতের কাছে এটা ছিল অশনি সংকেত।” তিনি আরও বলেন, “জিয়াকে নিয়ে বললে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। মানুষটা দেশের জন্য বুক দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। অথচ কাদের বিশ্বাস করেছিলেন, তা হয়তো শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝে উঠতেই পারেননি।”
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ নিয়ে উত্তপ্ত দ্বন্দ্ব
১৯৭০ সালে বঙ্গোপসাগরে ভেসে ওঠা একটি চরকে কেন্দ্র করে শুরু হয় জটিল ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। চরটির নাম দেওয়া হয় দক্ষিণ তালপট্টি। ভারতের দাবি সত্ত্বেও, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে দ্বীপটি বাংলাদেশের অধীনে রাখতে দৃঢ় অবস্থান নেন। ভারত যখন পতাকা টাঙিয়ে দখলের চেষ্টা চালায়, জিয়া তাৎক্ষণিকভাবে নৌবাহিনী পাঠিয়ে সেই পতাকা নামিয়ে আনেন। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ভারতকে স্পষ্ট বার্তা দেন তিনি।
এই ঘটনার ঠিক সাত দিনের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ঘটে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। রাষ্ট্রপতির মৃত্যু যে নিছক একটি সেনা অভ্যুত্থানের ফল নয় বরং সুপরিকল্পিত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র—তা একরামুল করিমের মতে এখন প্রমাণের অপেক্ষায়।
‘র’-এর অপারেশন ও সুব্রামানিয়ান স্বামীর স্বীকারোক্তি
একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে একরামুল করিম তুলে ধরেন ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুব্রামানিয়ান স্বামীর বক্তব্য। ভারতীয় ম্যাগাজিন ‘দ্য সানডে’-তে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে স্বামী বলেন, “রাষ্ট্রপতি জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল ‘র’। মোরারজী দেশাই এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন বলে তা প্রথমে বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফিরে আসার পর পরিকল্পনাটি পুনরায় সক্রিয় হয়।”
একরামুল করিমের ভাষ্য অনুযায়ী, জিয়াউর রহমান ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি পাহাড়ে ভারতপন্থী শান্তিবাহিনী দমনে সেনা পাঠান এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্ব্যর্থহীন ছিলেন। এসব পদক্ষেপ ‘র’-এর কাছে ছিল অগ্রহণযোগ্য।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস: স্বাধীনতা ধ্বংসের রাত
৩০ মে’র রাত। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়ার কক্ষের সামনে আকস্মিক গুলির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে। একরামুল বলেন, “সেই রাতে চট্টগ্রামের আকাশে শুধু গুলি নয়, গর্জে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মার আর্তনাদ। সার্কিট হাউসের দেওয়ালে এখনও রক্তের দাগ ও গুলির চিহ্ন লেগে আছে। এখন সেখানে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর গড়ে উঠেছে। কিন্তু ইতিহাস কি তা যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারছে?”
তিনি আরও বলেন, “প্রতিবার জাদুঘরে গেলে মনে হয়, জিয়া সাহেব যেন চিৎকার করে বলছেন—বাংলাদেশ বিক্রি করে দিয়েন না।”
ভিতরের বিশ্বাসঘাতক কারা?
বিদেশি ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য দেশের ভেতরেও যে মদতদাতা ছিল, তা নিশ্চিত করেন একরামুল করিম। তিনি বলেন, “একটি রাষ্ট্রপতিকে হত্যার মতো জঘন্য কাজ কেবল বিদেশি সংস্থা একা করতে পারে না। দেশের ভেতরে উচ্চপর্যায়ের কিছু ‘বিশ্বাসঘাতক’ সহযোগিতা না করলে এই অপারেশন অসম্ভব ছিল।”
তবে স্পষ্ট করে নাম বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বলেন, “যারা একসময় ‘জিয়া জিন্দাবাদ’ বলেছিল, পরে সামরিক শাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, তাদের দিকে এখন প্রশ্ন তুলতে হবে।”
ইতিহাস যেন অন্ধকারে না হারায়
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেন, “তারা জানে না দক্ষিণ তালপট্টি কী, কেন পাহাড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল, কিংবা কীভাবে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে আসছে।”
তার দাবি, জিয়াউর রহমান ছিলেন শুধু রাষ্ট্রপতি নয়, বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। “তাকে সরিয়ে দিয়ে সেই নিরাপত্তার বলয়টাই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়,”—এমন ভাষায় তিনি উপসংহার টানেন।