ধর্মীয় পরিচয়ের দায়ে নির্বাসন: ভারত থেকে বিতাড়নের শিকার মুসলমানরা বলছেন, আমরা তো ভারতেই জন্মেছি ভারতের সাম্প্রতিক অভিবাসন নীতির কারণে বাংলাদেশ সীমান্তজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়, আতঙ্ক এবং মানবিক সংকট। ২০২৫ সালের মে মাস থেকে শুরু করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বেআইনিভাবে ফেরত পাঠানো হয়েছে অন্তত ১৬০০ জন মুসলিম অভিবাসীকে — যাদের মধ্যে কেউ কেউ বাস্তবেই বাংলাদেশি, তবে অনেকেই প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক। ভারত সরকারের এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী এবং সাংবাদিকদের মতে, এই নির্বাসনের নেপথ্যে রয়েছে ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং জাতিগত পক্ষপাত। ভারত সরকার দাবি করছে, তারা অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠাচ্ছে। কিন্তু যারা ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাদের অনেকের কাছেই রয়েছে ভারতের জন্মনিবন্ধন, পরিচয়পত্র এবং ভোটার আইডি।
ভারতের মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মন্দার বলেছেন, “বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের মধ্যে এখন মারাত্মক ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছেন, কোনোদিন যেকোনো সময় তাদের ধরে সীমান্তে ফেলে দেওয়া হতে পারে।
মন্দার বলেন, “এটি শুধুই আইনভিত্তিক ইস্যু নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘৃণার ফলাফল। দেশের পূর্বাঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠী এখন ভীত, উদ্বিগ্ন, এবং পরিচয়হীনতায় ভুগছে।
আসামের রহিমা বেগম জানান, তাকে পুলিশ কয়েকদিন আটকে রাখার পর, রাতের অন্ধকারে সীমান্তে নিয়ে যায়। সেখানে আরও পাঁচজন মুসলমানকে জোর করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। তাদের বলা হয়, “হামাগুড়ি দিয়ে সামনে যাও, দাঁড়াবে না—না হলে গুলি করব।
রহিমা বলেন, “আমার দাদা, বাবা, স্বামী — সবাই এই দেশে জন্মেছেন। আমাদের অপরাধ কী ছিল জানি না।
বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীরা তাদের উদ্ধার করে আবার সীমান্তে পাঠিয়ে দেয়। এরপর ভারতীয় বাহিনী আবার রহিমাকে আসামে ফিরিয়ে নেয় — তবে হুমকি দেয়, “আর মুখ খুললে পরিণতি ভালো হবে না।
মুম্বাইয়ের নির্মাণ শ্রমিক নাজিমুদ্দিন মণ্ডল জানান, তাকে পুলিশ অফিস থেকে তুলে নিয়ে যায়, পরিচয়পত্র দেখালেও গুরুত্ব দেয়নি। পরে সামরিক বিমানে করে ত্রিপুরা সীমান্তে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, “আমি সরকার-প্রদত্ত আধার কার্ড দেখালাম। কিন্তু তারা একবারও যাচাই করল না। এখন আমি কাজে যাওয়ার সাহস পাই না।
নয়াদিল্লিভিত্তিক খ্যাতনামা আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে বলেন, “আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কাউকে তখনই ফেরত পাঠানো যায় যদি গ্রহণকারী রাষ্ট্র তা মেনে নেয়। অথচ এখানে কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই মানুষকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে — যা স্পষ্টতই বেআইনি।
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ সরকার বারবার জানিয়ে দিয়েছে তারা এদের অধিকাংশকে চেনে না। তবুও ভারতীয় বাহিনী সীমান্তে ঠেলে পাঠাচ্ছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও শীতল হয়ে পড়ে। অতীতে ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও বর্তমানে সীমান্ত সমস্যা ও অভিবাসন ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক চাপ বেড়েছে।
বাংলাদেশ দাবি করছে, ভারত থেকে যে লোকদের পাঠানো হচ্ছে, তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১০০ জন ভারতীয় নাগরিক — যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুজরাট, আসাম, উত্তর প্রদেশ, এবং ত্রিপুরা — এসব বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের ওপর নজরদারি ও ধরপাকড় সবচেয়ে বেশি।
গুজরাট পুলিশের তথ্যমতে, রাজ্যজুড়ে প্রায় ৬৫০০ জনকে আটক করা হয়েছে; যাদের মধ্যে অনেকেই বৈধ ভারতীয় হলেও শুধু ভাষাগত ও ধর্মীয় কারণে সন্দেহের তালিকায় পড়েছেন।
হর্ষ মন্দার বলেন, “বাংলা ভাষায় কথা বলা মানেই এখন ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কা। এটা নিছক কাগজপত্রের বিষয় নয়, এটা রাজনৈতিক ঘৃণার প্রকৃত প্রতিচ্ছবি।
ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অবস্থা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, এমনকি অস্তিত্ব নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে। আর এই সংকটের মুখে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেইসব মানুষ, যারা নিজেদের ভারতীয় পরিচয় দেখিয়েও স্বীকৃতি পাচ্ছেন না — শুধু মুসলমান ও বাংলা ভাষাভাষী হওয়ার অপরাধে।
এটা কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর ধর্মভিত্তিক বাছাইয়ের শুরুও হতে পারে।