বেড়েছে যক্ষ্মা রোগী, কমেছে বরাদ্দ—জনস্বাস্থ্য নিয়ে নতুন শঙ্কা!
দেশে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে এ রোগের বিস্তার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। অথচ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ, চিকিৎসা ও ওষুধের প্রাপ্যতা কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস, যার এবারের প্রতিপাদ্য— "প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ ও সেবাদান দ্বারা সম্ভব হবে যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়া।"
তবে বাস্তব চিত্র বলছে, বাংলাদেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি বরাদ্দ ও আন্তর্জাতিক সহায়তার অভাবে এই রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
বন্ধ হয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, বেকার হাজারো কর্মী
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে দেশের অন্যতম দুটি বড় প্রকল্প— আইসিডিডিআর,বি পরিচালিত এসএটিভি প্রকল্প ও এফএইচআই ৩৬০ পরিচালিত টিবি-ডিএনএস প্রকল্প— ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এই প্রকল্পগুলোর অধীনে কর্মরত কয়েক হাজার স্বাস্থ্যকর্মী এখন বেকার। দেশের বিভিন্ন জেলায় সেবা কেন্দ্রগুলো তালাবদ্ধ, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি স্থগিত এবং রোগী সেবাদান কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যক্ষ্মা শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কনসালট্যান্টদের চাকরি হারানো এবং জরুরি অ্যাম্বুলেটরি ডিজিটাল এক্স-রে সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রোগীদের জন্য চিকিৎসা পাওয়া আরও কঠিন হয়ে গেছে।
চিন্তার কারণ: ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগের বৃদ্ধি
বিশেষজ্ঞদের মতে, যক্ষ্মা রোগের সবচেয়ে বিপজ্জনক রূপ মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স (এমডিআর) যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রমও এখন হুমকির মুখে। ঢাকাসহ দেশের ছয়টি বক্ষব্যাধি হাসপাতালে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট) এমডিআর রোগীদের নিবিড় চিকিৎসা দেওয়া হতো। কিন্তু প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান: উদ্বেগজনক বৃদ্ধি
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (NTP) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের যক্ষ্মা পরীক্ষার মধ্যে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৬২৪ জনের শরীরে এই রোগ শনাক্ত হয়েছে।
🔹 ঢাকা: ৮৫,৬০৮ জন
🔹 চট্টগ্রাম: ৩০,৩০৯ জন
🔹 রাজশাহী: ৩৫,৮১৯ জন
🔹 রংপুর: ৩৪,৮৩৩ জন
🔹 খুলনা: ৩৪,০১৪ জন
🔹 বরিশাল: ১৯,৬০০ জন
🔹 সিলেট: ২২,০২২ জন
🔹 ময়মনসিংহ: ২১,৪১৯ জন
এছাড়া, রোহিঙ্গা ক্যাম্প (টেকনাফ, উখিয়া, ভাষানচর) এলাকায় ২,৭৫০ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে।
শিশু যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি
২০২৩ সালে শিশুদের মধ্যে যক্ষ্মা রোগ শনাক্তের হার ছিল ৪.৪%, যা ২০২৪ সালে ৫.২% এ পৌঁছেছে। এই বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে নতুন ব্যাকটেরিয়ার দ্রুত বিবর্তন এবং অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদেশি অনুদান বন্ধ—অসংখ্য কর্মী বেকার
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (USAID) তাদের অধীন চলমান সব প্রকল্পের অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে আইসিডিডিআর,বির অধীন এসিটিবি প্রকল্প, এফএইচআই ৩৬০ পরিচালিত টিবি-ডিএনএস প্রকল্পসহ বহু কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
আইসিডিডিআর,বি ইতিমধ্যেই ১,৫০০ কর্মীকে অব্যাহতি দিয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই যক্ষ্মা চিকিৎসা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভয়াবহ পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমডিসি) ডা. শামিম আরা নাজনীন এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (NTP) বিভাগীয় কনসালট্যান্ট ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন বলেন,
"যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সফল করতে হলে অবশ্যই বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। যক্ষ্মা রোগের জীবাণু ক্রমাগত বিবর্তিত হয়ে নতুন নতুন ওষুধ প্রতিরোধী রূপ নিচ্ছে, যা আরও ভয়াবহ হতে পারে। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে বরাদ্দ কমে যাওয়ায় কার্যকর প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাও সংকটে পড়েছে।"
উপসংহার
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, যক্ষ্মামুক্ত বিশ্ব গড়তে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ও সচেতনতা জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে বরাদ্দ কমার কারণে যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসা সংকটের মুখে পড়তে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই যদি সরকার কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই রোগ মহামারির রূপ নিতে পারে।



















