close
লাইক দিন পয়েন্ট জিতুন!
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, যেটি দীর্ঘকাল ধরে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে, তা আজ নানা কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। যদিও বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায় একত্রে বসবাস করে এসেছে এবং তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল, তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ঘটনার ফলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যার ফলে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর চাপ পড়ছে।
ইতিহাসের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাংলাদেশের জন্মের পেছনে ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা, যেখানে দেশের সকল ধর্মের মানুষের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে স্বাধীনতা লাভ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মাটিতে, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা সহঅবস্থান করেছেন শতাব্দী ধরে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই একযোগে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ছিলেন, যা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক।
সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ
তবে গত কয়েক দশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিস্থিতি কিছুটা কঠিন হয়ে উঠেছে। বিশেষত, ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, ২০১৬ সালের গুলশান হামলা, এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ, এসব ঘটনা দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক কিছু রাজনৈতিক ঘটনায়ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থে কখনও কখনও ধর্মীয় তত্ত্ব ও পরিচিতির ভিত্তিতে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে, যা দেশের ঐক্য ও সম্প্রীতির জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে নির্বাচনী পরিস্থিতিতে এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে ধর্মীয় উস্কানির ঘটনা বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। এটি ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কেও কিছুটা প্রভাব ফেলছে, যেখানে কখনও কখনও বাংলাদেশে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা হয়েছে।
সরকারের পদক্ষেপ ও উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নানা আইন ও নীতির মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, "বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, এখানে সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকার রয়েছে," যা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সরকারের অবস্থানকে স্পষ্ট করে।
এছাড়া, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতার প্রচার করা হচ্ছে। সরকারি পর্যায়ে এই ধরনের বার্তা প্রচার করা হলেও, মাটি থেকে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, কখনও কখনও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয় যা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা
বাংলাদেশের সমাজে প্রায়ই দেখা যায় ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, মঠ এবং অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনাগুলো বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য একে অপরকে সহানুভূতির সঙ্গে জানার সুযোগ করে দেয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে সবাই একত্রিত হয়ে আনন্দে মেতে উঠে, যা ধর্মীয় বিভেদ দূর করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শক্তিশালী করে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে আলোচনা ও কর্মশালা আয়োজন করা হয়, যা তরুণ সমাজের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সেতুবন্ধন তৈরি করতে সহায়তা করে। এসব উদ্যোগ ধর্মীয় সম্প্রীতির ভিত্তি মজবুত করতে সহায়ক।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধির সম্ভাবনা সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব, শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আরও দৃঢ় হতে পারে। দেশব্যাপী ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার প্রসারের জন্য সরকার, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি, রাজনৈতিক দলগুলোকে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করার পরিবর্তে দেশকে একত্রিত করার জন্য কাজ করতে হবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং শান্তির গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশকে বিশ্বের ধর্মীয় সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, একদিকে যেমন একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তেমনি একটি বড় অর্জনও। নানা ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবের পরেও, বাংলাদেশ এখনও তার বহুবিধ ধর্মের মানুষের জন্য একটি সম্প্রীতির সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে এই সম্প্রীতি বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। তবে, সরকারের সদর্থক পদক্ষেপ এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের সমর্থন এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন, লেখক ও সাংবাদিক
No comments found