অদম্য ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত গড়েছেন শরীয়তপুরের উল্লাস পাল। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কখনো তার স্বপ্নের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সমাজের বহু মানুষের করুণা, অনেকের হাসি-ঠাট্টা পেরিয়ে—এই যুবক আজ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারে জায়গা করে নিয়েছেন।
সম্প্রতি ৪৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। সেই ফলাফলে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন উল্লাস পাল। এর আগে তিনি ৪৩তম বিসিএসেও শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এবং বর্তমানে নড়িয়া সরকারি কলেজে প্রভাষক পদে কর্মরত। তবে প্রশাসন ক্যাডারই ছিল তার চূড়ান্ত লক্ষ্য, যা অবশেষে অর্জন করলেন এই সংগ্রামী তরুণ।
উল্লাসের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর গ্রামে। বাবা মৃৎশিল্পী উত্তম কুমার পাল ও মা আন্না রানী পালের বড় সন্তান তিনি। জন্ম থেকেই দুটি হাত ও পা বাঁকা ছিল তার। শৈশবে হাঁটতে পারতেন না। পরিবারের সহযোগিতায় ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। এক পায়ে অস্ত্রোপচারের পর ধীরে ধীরে হাঁটতে শিখলেও তা ছিল অস্বাভাবিক।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় থেকেই ছিল তার অদম্য স্পৃহা। বর্ষায় স্কুলে যেতে পারতেন না বলে বাবা কোলে করে নিয়ে যেতেন। তবু থেমে থাকেননি। বাম হাতে লিখে তিনি শুরু করেন লেখাপড়া। কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা এবং ২০১০ সালে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ নিয়ে মাধ্যমিক পাস করেন।
উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন ঢাকা নর্দান কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকেই বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেন। ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিসিএস পর্যন্ত যাত্রাটি ছিল কণ্টকাকীর্ণ—তবু পিছপা হননি তিনি।
৪০তম বিসিএসে মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও কোনো ক্যাডার বা নন-ক্যাডার পদে সুপারিশ পাননি উল্লাস। ৪১তম বিসিএসে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হলেও থেমে থাকেননি। তার লক্ষ্য ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়া—সেটা শুধুই শিক্ষা ক্যাডার নয়, প্রশাসন ক্যাডার।
৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নড়িয়া সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তবে সেখানে তৃপ্ত থাকতে পারেননি। নিজের লক্ষ্য স্পষ্ট ছিল—প্রশাসন ক্যাডার হওয়া। এবং ৪৪তম বিসিএসে সেই স্বপ্ন বাস্তব হলো।
উল্লাস বলেন, “রেজাল্টের সময় নিজের রেজিস্ট্রেশন নম্বর যখন প্রশাসন ক্যাডারে খুঁজে পেলাম, তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুরা সবাই খুব খুশি হয়েছে।” তিনি জানান, “শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে সমাজে অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। কিন্তু আমি দমে যাইনি। আমার লক্ষ্য ছিল স্থির।”
তিনি আরও বলেন, “শিক্ষা ক্যাডারে চাকরি পেলেও তৃপ্তি পাইনি। প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার জন্য পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি। আমার লক্ষ্য ছিল বড়, আজ সেটা পূরণ হলো।
উল্লাস পালের মতে, “যারা শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নিয়েছে, তারা যেন সমাজে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে সেই পরিবেশ তৈরি করা দরকার। শুধু রাষ্ট্র নয়, সমাজের প্রতিটা মানুষের দায়িত্ব রয়েছে এই জায়গায় সহানুভূতিশীল হওয়া।”
তিনি বলেন, আমি এখন যে দায়িত্ব পাব, সেটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করব। প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে মানুষের পাশে থেকে কাজ করাই হবে আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি।
উল্লাসের মা আন্না রানী পাল বলেন, “আমার ছেলে অনেক কষ্ট করে আজ এই জায়গায় এসেছে। আমরা ওকে নিয়ে গর্বিত। সে যেন মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে পারে এটাই আমাদের চাওয়া।”
বাবা উত্তম কুমার পাল বলেন, ছেলেকে সবসময় আলাদাভাবে যত্ন করে বড় করেছি। ওর এই সাফল্য আমাদের চোখে পানি এনে দিয়েছে। আমরা খুব আনন্দিত।
উল্লাস পালের গল্প আমাদের শেখায়, শারীরিক সীমাবদ্ধতা কোনো কিছু নয়—আসল শক্তি হচ্ছে মনোবল। বাংলাদেশের লাখো তরুণের জন্য তিনি এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা। তার এই সাফল্য শুধু তার একার নয়, এটি সমাজের সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে চাওয়া প্রতিটি মানুষের বিজয়ের প্রতিচ্ছবি।