অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এক গভীর সন্ধিক্ষণ। দায়িত্ব পালনের পথে বারবার বাধা, বিদেশি ষড়যন্ত্র ও পরাজিত শক্তির উসকানিতে অচলাবস্থার হুমকির মধ্যে পরিষ্কার ভাষায় নিজেদের অবস্থান জানালো উপদেষ্টা পরিষদ। তারা বলেছে—সরকার যদি দায়িত্ব পালনের সুযোগ না পায়, তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
শনিবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। এর আগে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে অনুষ্ঠিত হয় উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত বৈঠক, যেখানে উপস্থিত ছিলেন ১৯ জন উপদেষ্টা।
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের তিনটি প্রধান দায়িত্ব—সুষ্ঠু নির্বাচন, বিচারিক কার্যক্রম এবং সংস্কার—এই তিন ক্ষেত্রেই নানা রকম চাপ, অযৌক্তিক দাবি, এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মসূচি সরকারের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। এতে জনমনে সন্দেহ ও সংশয় তৈরি হচ্ছে। যদি এই চাপে সরকারের দায়িত্ব পালন অসম্ভব হয়ে ওঠে, তাহলে সরকারের তরফ থেকে সবকিছু জনসমক্ষে তুলে ধরা হবে এবং তখন জনগণের মত নিয়েই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
গুজব ও গুঞ্জন: প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ?
সাম্প্রতিক সময়ে সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর পদত্যাগের গুঞ্জনে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে রাজনীতির অঙ্গনে। সূত্র মতে, বৃহস্পতিবার একটি অনির্ধারিত বৈঠকে তিনি নিজেই পদত্যাগের ভাবনার কথা বলেন, উল্লেখ করেন সরকারের কাজে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা। এই খবরে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয় আলোড়ন।
তবে বৈঠক শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ স্পষ্ট করে জানান, প্রধান উপদেষ্টা কোথাও এমন কিছু বলেননি যে তিনি চলে যাবেন। তিনি এখনো দায়িত্বে আছেন এবং তার নেতৃত্বে সরকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সরকারের অগ্রগতির পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। তা শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, রয়েছে বিদেশি হস্তক্ষেপের ইঙ্গিতও। বৈঠকে উপদেষ্টারা জানিয়েছেন—তাঁদের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে সংস্কার কাজ চালাতে গিয়ে কোথা থেকে কোথায় বাধা আসছে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের ভিত্তি হচ্ছে জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থান। জনগণের এই সমর্থনের কারণেই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এখন যেসব শক্তি দেশকে অস্থির করে তুলতে চাইছে, তাদের মোকাবিলা করেই সামনে এগোতে হবে।
রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে প্রতিদিন
সরকারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও বিভক্তি দেখা যাচ্ছে। বিএনপি দাবি তুলেছে অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগের, বিশেষ করে ছাত্র ও নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের। অন্যদিকে এনসিপির একজন নেতা সরাসরি অভিযোগ করেছেন—কয়েকজন উপদেষ্টা বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন।
এ প্রসঙ্গে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা বক্তব্যটি দলীয় ছিল না বরং ব্যক্তিগত পর্যায়ের। তিনি আরও বলেন, “এই দায়িত্ব স্বপ্রণোদিতভাবে কেউ নেয়নি। দায়িত্ব যদি উপভোগ্য না হয়, তবু দায়িত্ববোধ থেকেই আমরা আছি।”
নির্বাচন ও সংস্কারে ঐক্য চান উপদেষ্টা পরিষদ
উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে বলা হয়, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার—এই তিন ক্ষেত্রেই সফলতা আনতে হলে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের সহযোগিতা অপরিহার্য। এজন্য বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজন। সরকার সব রাজনৈতিক দলের বক্তব্য শুনবে এবং নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করবে।
রাতের বৈঠকে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি
গতকাল রাতেই প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে বিরাজমান সংকট ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয় বলে সূত্র জানিয়েছে।
উপসংহার
একদিকে অভ্যন্তরীণ বাধা, অন্যদিকে বিদেশি ষড়যন্ত্রের ছায়া—এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এখন এক কঠিন সঙ্কটে। তবে উপদেষ্টা পরিষদের বক্তব্য স্পষ্ট—সরকার দায়িত্ব পালনের সুযোগ না পেলে, সেই সিদ্ধান্ত আসবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে।