বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী দীর্ঘদিন ধরে সরকারের নির্ধারিত খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্তে, যা দেশের প্রাসঙ্গিক সংবাদ মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, এই খাদ্য সহায়তার পরিমাণ সাড়ে ১২ ডলার থেকে কমে ৬ ডলারে নামিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ রোহিঙ্গাদের মধ্যে নতুন এক অস্থিরতা এবং ভবিষ্যতের ব্যাপারে অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে, রোহিঙ্গাদের দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি প্রভাব পড়বে। ক্যাম্পে থাকা শরণার্থী তরুণ আজিজুল হকের মতে, "আগামী মাস থেকে রেশনের পরিমাণ কমিয়ে দিলে আমাদের সংসারের মূল ভোগবস্তুগুলো যেমন ডিম, ডাল, চিনি—এসবের পরিমাণ অপর্যাপ্ত হয়ে যাবে।" এমন প্রত্যাশায় অনেকেই আগেভাগে অতিরিক্ত খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহ করে রাখছেন।
জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি (WFP) এর পূর্ব ঘোষণা এবং জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের আগত সফরের সময়ে এই পদক্ষেপের প্রেক্ষাপট যেন আরো স্পষ্ট হয়। রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তার এই হ্রাস তাদের জীবিকার ওপর এক নতুন সংকটের ছায়া ফেলতে পারে এবং ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা ও স্বাস্থ্যগত অবস্থা আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
নির্দিষ্ট করে বলা যায়, খাদ্য সহায়তার এই হ্রাসের ফলে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার কথা ভাবছেন। বার্তায় উঠে এসেছে, "আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই, যদি আমাদের পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা থাকে।" এ বক্তব্যে স্পষ্ট যে, রোহিঙ্গাদের বর্তমান খাদ্য সংকট তাদের মানসিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের আগত সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের সমর্থন ও সলিডারিটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন ইস্যুর কথা শোনা হবে। শরণার্থী ও ত্রাণ প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, “এই পদক্ষেপের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা বিশ্বাস ফিরে পাবে যে, বিশ্ব সম্প্রদায় তাদের পাশে রয়েছে। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, প্রত্যাবাসন বিষয়টি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয়, বরং মিয়ানমারেরও একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়।”
বাংলাদেশ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে যে পর্যায়ে নিতে হয়েছে, তা কেবলমাত্র আর্থিক ও সংস্থানগত সীমাবদ্ধতার ফলাফল নয়, বরং একটি বৃহত্তর কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। আন্তর্জাতিক দাতাদের অর্থায়নে যে তহবিল প্রবাহিত হচ্ছে, তার উপর নির্ভরতা কমানো এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখা—এই দুইটি মূল অঙ্গ এই পদক্ষেপের পিছনে স্পষ্ট প্রেরণা।
সেই সঙ্গে, যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা সমস্যাকে রাজনৈতিক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেওয়া বাধ্যতামূলক। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থার অবনতি দেশের প্রতিরক্ষা ও নীতি-নির্ধারণে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। এতে দেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়া দুটোরই ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে অভিজ্ঞ বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বাংলাদেশ সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্তের সাথে সাথে, দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই সমাধানের দিকে মনোযোগ দেওয়া। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সাথে সমন্বয় করে, রোহিঙ্গাদের জন্য আরও পর্যাপ্ত খাদ্য ও মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সুসংগঠিত ও মানবিক হোক—যাতে রোহিঙ্গারা তাদের দেশে নিরাপদে ফিরে যেতে পারেন এবং দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি বজায় থাকে।
বর্তমান খাদ্য সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের সূচনা করেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, এই পদক্ষেপের প্রভাব বিশেষভাবে নজরে পড়ছে। দেশের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও কৌশলগত সমাধানের দিকে মনোযোগ দিয়ে, একটি মানবিক ও সুশৃঙ্খল সমাধান গড়ে তোলা সম্ভব। যারা দেশের স্বার্থ নষ্ট করার চেষ্টা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া বাধ্যতামূলক—এবং এই পদক্ষেপটি অবশ্যই দেশের নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক মর্যাদাকে পুনর্নির্মাণে সহায়ক হবে।