মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত আকাশে এখন ছড়িয়ে আছে বারুদের গন্ধ। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান বৈরিতা যেন এক নতুন রূপ নিয়েছে—যেখানে ইরান তার বিপুল ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইসরায়েলের ওপর। আর এই হামলার মুখে চিরচেনা আত্মবিশ্বাস হারাতে বসেছে ইসরায়েলের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ‘আয়রন ডোম’।
তেহরানের দাবি অনুযায়ী, তাদের ছোড়া ব্যালিস্টিক মিসাইল ইসরায়েলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আঘাত হেনেছে, যা ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এক বড় ব্যর্থতা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। মধ্য ইসরায়েলের আবাসিক এলাকায় হামলার ঘটনা শুধু আতঙ্কই বাড়ায়নি, বরং এক অজানা ভবিষ্যতের ইঙ্গিতও দিচ্ছে।
ইসরায়েলের লাগাতার হামলার পর পাল্টা জবাবে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে ইরান। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৪ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন শতাধিক। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। সাধারণ মানুষ দৌঁড়াচ্ছেন বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে, আর সরকার কঠোরভাবে আহ্বান জানাচ্ছে ঘরে থাকার।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আঘাত হেনেছে এমনকি রাজধানী তেলআবিবের ‘কিরিয়া’ সামরিক সদরদপ্তরেও। যদিও ইসরায়েল দাবি করছে, ক্ষয়ক্ষতি সীমিত, কিন্তু হামলার গভীরতা থেকেই বোঝা যাচ্ছে ইরান এবার ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছে ।
২০১১ সালে চালু হওয়া এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ঘিরে বহু সাফল্যের গল্প আছে। স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসে যার সাফল্যের হার ৯০% এর বেশি বলে প্রচারিত। তবে আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। একদিকে ইরান ছুঁড়ছে অসংখ্য ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র একসাথে—অন্যদিকে ইসরায়েলের ইন্টারসেপ্টর মিসাইল দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একযোগে এত বড় মাত্রায় আক্রমণ হলে কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই এককভাবে সফল হতে পারে না। তেহরানের লক্ষ্য পরিষ্কার—ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ভেঙে দিতে হবে। সেই লক্ষ্যেই তারা একসাথে ব্যবহার করছে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ মিসাইল, রাডার ব্লাইন্ডিং প্রযুক্তি এবং ডিকয় সিস্টেম।
ইরানের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘ফাত্তাহ-২’ শব্দের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ গতিতে চলে এবং গতিপথ পাল্টাতে পারে। এ ধরনের প্রযুক্তি প্রথাগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে ‘হোভেইজেহ’ নামের ক্রুজ মিসাইল কম উচ্চতায় ও ধীরে চলায় প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিকে ফাঁকি দিতে সক্ষম।
এই মিসাইলগুলোর মধ্যে এমন কিছু রয়েছে, যেগুলোতে আছে রাডার জ্যামিং প্রযুক্তি—যা শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিভ্রান্ত করতে পারে। তাছাড়া ইরান জাল টার্গেটও পাঠাচ্ছে, যেগুলো দেখে প্রতিরক্ষা সিস্টেম ভুল সিগনাল ধরে বাস্তব লক্ষ্যবস্তু হারাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, উভয় দেশই ধীরে ধীরে ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের দিকে এগোচ্ছে। আল জাজিরার প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অ্যালেক্স গাটোলোপুলোস বলেছেন, “ইসরায়েলের আকাশ দখলের দাবি যতই থাকুক, ইরানের এত দূর থেকে (১,০০০ কিমি দূরত্ব) নিয়মিত হামলা চালানো অসম্ভব নয়, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী রাখতে হলে জ্বালানি ও অস্ত্র সরবরাহ বড় চ্যালেঞ্জ।”
তবে তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—এই যুদ্ধ যদি পূর্ণমাত্রার আকার ধারণ করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, লেবানন ও অন্যান্য শক্তিগুলো এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। তখন আর এটা শুধু একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ থাকবে না, বরং রূপ নেবে এক বৈশ্বিক যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে।
এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক রাজনীতি চরম উত্তেজনায় ঠাসা। ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব নতুন কোনো বিষয় নয়, কিন্তু বর্তমান পরিসরে যা ঘটছে তা নজিরবিহীন। একদিকে ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের আস্থা ‘আয়রন ডোম’ মুখ থুবড়ে পড়ছে, অন্যদিকে ইরানও নিশ্চিন্ত নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই সংঘাত শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে, আর সেই আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে ইউরোপ ও এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে। যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেটা হবে এক ভয়াবহ আন্তর্জাতিক অগ্নিসংযোগ।