কাশ্মিরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দেশজুড়ে সতর্ক অবস্থান নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত এক মাসে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অন্তত ১৫ জন সাধারণ নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছিল। এই ধরা পড়া ব্যক্তিরা ছিলেন শিক্ষক, ভ্লগার, সরকারি কর্মচারী, এমনকি স্বাস্থ্যকর্মী পর্যন্ত।
ভেতর থেকেই ছিদ্র: সিআরপিএফ সদস্য মোতি রাম জাট
সিআরপিএফ-এর এক সদস্য মোতি রাম জাট, যিনি অপারেশনাল তথ্যের প্রবেশাধিকার রাখতেন, তিনি টাকার বিনিময়ে গোপন তথ্য পাঠাতেন পাকিস্তানে। এনআইএ (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি)-র তথ্য অনুযায়ী, জাট ২০২৩ সাল থেকেই পাকিস্তানি গোয়েন্দা অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। সম্প্রতি দিল্লি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কী ধরনের গোপন তথ্য পাচার হয়েছে, তা নিয়ে চলছে জোর তদন্ত।
ফেসবুক ফাঁদে ডকইয়ার্ডের ইঞ্জিনিয়ার: রবিন্দ্র বর্মার কাহিনী
মুম্বাইয়ের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার রবিন্দ্র বর্মা ফেসবুকে হানি ট্র্যাপে পড়েন। তিনি ‘পায়াল শর্মা’ নামে প্রোফাইলের পেছনে থাকা পাকিস্তানি এজেন্টের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। নিজের কাজের জায়গা—ডকইয়ার্ড থেকে নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন সংক্রান্ত স্কেচ, অডিও নোট পাঠাতেন। ডকইয়ার্ডে ফোন নিষিদ্ধ থাকলেও তিনি নিজের স্মৃতি থেকে স্কেচ করে ছবি পাঠাতেন। নভেম্বর ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত এই কাজ চালিয়ে যান তিনি।
সেলিব্রিটি গুপ্তচর! ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রা ও তার লাহোর অভিযান
হরিয়ানার জনপ্রিয় ট্রাভেল ভ্লগার জ্যোতি মালহোত্রা পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন—এমন অভিযোগে গ্রেফতার হন। তার ফোন ও ল্যাপটপ থেকে ১২ টেরাবাইটের বেশি ডেটা উদ্ধার হয়। এক স্কটিশ ইউটিউবারের ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি ছয়জন একে-৪৭ বহনকারী সশস্ত্র ব্যক্তির সঙ্গে লাহোরের আনারকলি বাজারে হাঁটছেন। তাকে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও আইপিসি ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।
গুজরাটের স্বাস্থ্যকর্মী গোহিল: হোয়াটসঅ্যাপে ছবি ও ভিডিও পাচার
সাহেদেব সিং গোহিল, গুজরাটের একজন স্বাস্থ্যকর্মী, ভারতীয় বিমানবাহিনী ও বিএসএফ-এর সামরিক স্থাপনার ছবি ও ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতেন একজন পাকিস্তানি এজেন্টকে। তিনি ৪০ হাজার টাকা নগদ পান এবং তদন্তকারীরা তার ফোন থেকে আরও তথ্য উদ্ধারে কাজ করছে।
হরিয়ানায় ছাত্র ও নিরাপত্তা কর্মীসহ গোটা ক্লাস্টার গ্রুপ ধরা
পাটিয়ালার ছাত্র দেবেন্দর সিং ধিল্লন ও পানিপথের নিরাপত্তা গার্ড নোমান ইলাহি গ্রেফতার হন সেনা স্থাপনার ছবি পাঠানোর অভিযোগে। নোমান তার শ্যালকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে টাকা লেনদেন করতেন। একই সঙ্গে আরও দুজন যুবককে নূহ জেলা থেকে গ্রেফতার করা হয়, যারা পাকিস্তানি নম্বরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল।
রাজস্থানের প্রশাসনিক সংযোগ: শাকুর খান ও মন্ত্রীর যোগসূত্র
জয়সলমারের সরকারি কর্মচারী শাকুর খান, যিনি এক সময় মন্ত্রীর সহকারী ছিলেন, পাকিস্তানে সাতবার ভ্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টে মুছে ফেলা ডেটা ও সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন পাওয়া গেছে, যা এখন কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তাধীন।
সিম কার্ড ও অ্যাপ দিয়ে তথ্য পাচার: রাজস্থানের কাসিম ও মুম্বাইয়ের অজ্ঞাত ব্যক্তি
রাজস্থানের কাসিম ভারতীয় মোবাইল সিম কার্ড অবৈধভাবে পাকিস্তানে সরবরাহ করতেন। তিনি আইএসআই এজেন্টদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেন। অন্যদিকে, মুম্বাইয়ের এক ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করা হয়েছে, যিনি ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে হানি ট্র্যাপ হয়ে সেনা তথ্য পাঠাচ্ছিলেন।
ব্যবসায়ী ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও আইএসআই নেটওয়ার্কে
উত্তরপ্রদেশের ব্যবসায়ী শাহজাদ ও জালন্ধরের মোহাম্মদ মুরতাজা আলীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুরতাজা মোবাইল অ্যাপ দিয়ে তথ্য পাঠাতেন। আরও দুই ব্যক্তিকে—গজালা ও ইয়ামিন মোহাম্মদ—তদন্তের আওতায় রাখা হয়েছে।
ভারতের অভ্যন্তরে নীরব যুদ্ধ: আরও বহুজন নজরে
এইসব গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির বাইরেও প্রশাসনের দাবি, আরও বহু ভারতীয় আইএসআই-এর হয়ে কাজ করছেন। কেবল অর্থ, মিথ্যা প্রেমের ফাঁদ ও সামাজিক দুর্বলতাকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে পরিণত করা হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকিতে।
এত অল্প সময়ে এত বিস্তৃত এক গুপ্তচর নেটওয়ার্কের উদ্ঘাটন গোটা দেশের জন্য অ্যালার্মিং। সামান্য প্রলোভনে কত মানুষ বিপথে যাচ্ছে, তার বাস্তব উদাহরণ এই ঘটনাগুলো। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এখন আরও শক্ত হাতে তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া উপায় নেই।



















