আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের যেসব নেতাকর্মী ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যা এবং অতীতের বিভিন্ন দমন-পীড়নমূলক কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িত নন, তাদেরকে দায়মুক্তি দিয়ে জাতি গঠনে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে একটি সংগঠন। ‘তওবা কমিশন’ নামের একটি ব্যতিক্রমী কাঠামো তৈরির দাবি তুলে ধরেছে ইনকিলাব মঞ্চ নামের একটি সংগঠন।
রবিবার (১১ মে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদী এ দাবি জানান।
কি বললেন মুখপাত্র হাদী?
তিনি বলেন,
“আওয়ামী লীগের যারা গণহত্যায় জড়িত নন, যাদের হাতে রক্তের দাগ নেই, তাদেরকে একটি সুযোগ করে দিতে হবে যেন তারা আত্মস্বীকৃতির মাধ্যমে জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেন। এ জন্য একটি ‘তওবা কমিশন’ গঠন করা দরকার, যারা তাদের বক্তব্য শুনে জাতীয়ভাবে দায়মুক্তি দিতে পারবে।”
তাঁর দাবি অনুযায়ী, এ কমিশন দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলা এবং গ্রামে গিয়ে এমন নেতাকর্মীদের স্বীকারোক্তি নেবে যারা অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কোনও সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। তারা সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে বলবে:
“আমি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলাম, আমি আমার অতীত ভুল স্বীকার করছি, এবং আমি নিজেকে পরিবর্তন করতে চাই।”
বিদেশি উদাহরণ টেনে যুক্তি
শরিফ হাদী বলেন,
“এমন আত্মস্বীকৃতির পদ্ধতি বিশ্বের বহু দেশেই আছে। যেখানে অপরাধে সরাসরি জড়িত না থাকা ব্যক্তি ভুল স্বীকার করে সমাজে ফিরতে পারে। বাংলাদেশেও সেই রকম একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন জরুরি।”
তিনি আরো বলেন,
“এই মানুষগুলোকে আমরা জাতি গঠনে বাদ দিতে চাই না। যারা সত্যিই রক্তপাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তারা যেন নিজেদের সংশোধনের সুযোগ পান এবং তাদের অভিজ্ঞতাকে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য কাজে লাগানো যায়।”
‘জামায়াত নিষিদ্ধ’ প্রসঙ্গ টেনে তুললেন
সংবাদ সম্মেলনে জামায়াত প্রসঙ্গ টেনে হাদী বলেন,
“যখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়, তখন আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম—যেসব সদস্য একাত্তরের দায়ে জড়িত নন, তাদের আমরা জাতি গঠনে ব্যবহার করব কি না? একইভাবে, আওয়ামী লীগেও এমন বহু ব্যক্তি আছেন যারা সহিংসতা বা রক্তপাতের সঙ্গে জড়িত নন।”
তিনি বলেন, একাত্তরের ঘাতকদের যেমন বিচারের মুখোমুখি করা জরুরি, তেমনি যাদের দায় নেই, তাদের জাতি গঠনে ভূমিকা রাখা দরকার।
পূর্ব রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির পর শাপলা চত্বরে রাতভর অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এই ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করলেও সরকার বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে।
তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে অনেক নেতাকর্মী ছিলেন যারা সরাসরি এসব ঘটনায় অংশ নেননি, বরং দলীয় আদর্শের প্রতি আনুগত্যের জায়গা থেকেই সক্রিয় ছিলেন।
জাতীয় পুনর্গঠনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দাবি
ইনকিলাব মঞ্চের এই প্রস্তাব মূলত একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক পুনর্গঠন এবং সামাজিক মাফ করার সংস্কৃতিকে সামনে আনার প্রয়াস। তারা মনে করে—সহিংস রাজনীতির ইতিহাস থেকে উত্তরণ এবং সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে এই উদ্যোগ একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হতে পারে।
তাদের মতে, যেসব ব্যক্তি রক্তপাত, দুর্নীতি, অন্যায় কর্মকাণ্ডে জড়িত নন, অথচ শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে সমাজে নিগৃহীত হচ্ছেন, তাদের সামনে আত্মসমালোচনার একটি সুযোগ সৃষ্টি করে নতুন করে পথচলার সুযোগ দেওয়া উচিত।
‘তওবা কমিশন’ নামের এই প্রস্তাব আপাতদৃষ্টিতে ব্যতিক্রমী হলেও, এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গঠনমূলক রূপান্তরের জন্য এক নতুন আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করছে। এখন দেখার বিষয়—এই দাবি রাজনৈতিক মহলে কতটা গুরুত্ব পায় এবং কোনো নীতিনির্ধারণী স্তরে তা আলোচিত হয় কি না।