৩ মাস ধরে অস্ত্রোপচার বন্ধ, ডাক্তার সংকটে মৃত্যু ঝুঁকিতে রাজবাড়ীর রোগীরা
রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেন চিকিৎসা ব্যবস্থার এক চরম দুরবস্থার প্রতিচ্ছবি। ৫০ শয্যার এই সরকারি হাসপাতালটিতে ১৭ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৪ জন। ফলে গত তিন মাস ধরে সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে অস্ত্রোপচার কার্যক্রম। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা, বিশেষ করে প্রসূতি ও গুরুতর রোগীরা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ৫০ শয্যার অনুমোদন থাকলেও বাস্তবে হাসপাতালটি ৩০ শয্যার সরঞ্জাম ও সুবিধা পায়। বর্তমান জনবল সংকটে হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে উঠেছে কঠিন। যেখানে থাকার কথা ১ জন ইউএইচএফপিও, ৪ জন জুনিয়র কনসালটেন্ট, ৩ জন মেডিকেল অফিসার, ৭ জন সহকারী সার্জন ও ১ জন ডেন্টাল সার্জন, সেখানে শুধুমাত্র ১ জন ইউএইচএফপিও, ১ জন গাইনি কনসালটেন্ট ও ২ জন মেডিকেল অফিসার কর্মরত রয়েছেন।
অন্যদিকে, ৪ জন চিকিৎসক প্রেষণে অন্যত্র নিয়োজিত এবং ২ জন চিকিৎসক প্রশিক্ষণে রয়েছেন। ফলে অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসক না থাকায় গত ৩ মাসে কোনো অস্ত্রোপচার সম্ভব হয়নি। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে একজন অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ যোগ দিলেও, চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে বদলি করা হয়। সেই সময়ে ২২টি সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়েছিল, যা বর্তমানে সম্পূর্ণ বন্ধ।
বিপাকে গর্ভবতী নারীরা, ছুটছে বেসরকারি ক্লিনিকে
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, হাসপাতালে অস্ত্রোপচার না হওয়ায় এখন রোগীদের জেলা সদর বা বেসরকারি ক্লিনিকে যেতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এতে যেমন বাড়ছে ব্যয়, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে অনেক জটিল রোগীর চিকিৎসা। কালিকাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মকসেদ মিয়া বলেন, “আমার মেয়ের প্রসববেদনা শুরু হলে হাসপাতালে নিয়ে যাই, কিন্তু গিয়ে শুনি এখানে সিজার হয় না। পরে অনেক খরচ করে তাকে বেসরকারি ক্লিনিকে নিতে হয়েছে।”
চিকিৎসকদের দুর্ভোগ আর কর্তৃপক্ষের আশ্বাস
কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইসরাত জাহান উম্মন বলেন, “আমরা চিকিৎসক সংকটে চরমভাবে ভুগছি। রোগীদের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও অসহায় অবস্থায় আছি। আমাদের এখানে শুধু সিজার হয়, সেটাও গত তিন মাস বন্ধ। বিষয়টি জেলা সিভিল সার্জনকে জানিয়েছি।”
জেলা সিভিল সার্জন এস এম মাসুদ জানিয়েছেন, “চিকিৎসক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। মৌখিক ও লিখিতভাবে বারবার অবহিত করা হয়েছে।”
সরেজমিনে চিত্র আরও করুণ
সরাসরি গিয়ে দেখা গেছে, কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সোনাপুর মোড় থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে মাঠের ভেতরে অবস্থিত। নিরিবিলি পরিবেশে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনের সামনেই দেখা মেলে দু-তিনটি ভ্যান ও একটি প্রাইভেট কারের। ভবনের ভেতর জরুরি বিভাগে চিকিৎসক বসে থাকলেও ওটি বিভাগ সম্পূর্ণ অচল। অস্ত্রোপচারের কোনো প্রস্তুতি বা কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
নাগরিকদের প্রশ্ন—এই অবস্থায় চিকিৎসা সেবা কোথায়?
স্থানীয়দের মধ্যে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, “যেখানে সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা পাওয়া যায় না, সেখানে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?” তারা বলছেন, রাজবাড়ী জেলার প্রতিটি উপজেলায় সমানভাবে চিকিৎসক নিশ্চিত না হলে সাধারণ মানুষ সেবাবঞ্চিতই থাকবে।
উপসংহার
সরকারি হাসপাতালগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা চিকিৎসক সংকট। আর সেই সংকট যদি অস্ত্রোপচার বা জরুরি চিকিৎসাসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে হয়, তবে তা জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে পরিণত হয়। রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তার বাস্তব উদাহরণ। সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে এ সমস্যার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।