দেশের রাজনীতির মাঠে যখন এক গভীর অনিশ্চয়তা ও অন্তর্বর্তী সরকারের নানা চ্যালেঞ্জ—ঠিক তখনই এক রহস্যঘেরা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে ২৬ এপ্রিলের ‘সুন্নী সমাবেশ’। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে কেন্দ্র করে যে সমাবেশের ডাক দিয়েছে দেশের একাংশ পীর-মাশায়েখ ও সুন্নী অনুসারীরা, সেই কর্মসূচিকে ঘিরে গোপনে তৎপর হয়ে উঠেছে ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা।
বিশেষ করে আলোচিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, যেটিকে ইতোমধ্যেই একাধিক সূত্র নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে, সেই সংগঠনের নেতাকর্মীদের একাংশ ‘সুন্নী সমাবেশ’-কে কেন্দ্র করে ফের সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটিকে দেখছেন একটি বড়সড় ‘স্ট্র্যাটেজিক রি-এন্ট্রি’ হিসেবে—যেখানে ধর্মীয় আবেগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মাঠে নামার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
গোপন অভিযান? ‘সুন্নী সমাবেশ’কে পুঁজি করে মাঠে ফেরার চেষ্টা
রাজনৈতিক সূত্র বলছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি ও তার মন্ত্রিসভার শীর্ষ নেতারা দেশ ত্যাগ করলেও, কিছু মধ্যমপদস্থ নেতা দেশে থেকেই গোপনে সংগঠনের পুনর্গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে জনমনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, “ম্যাস গ্যাদারিং ফর প্যালেস্টাইন” শীর্ষক এই সমাবেশটি প্রথম দেখায় আন্তর্জাতিক মানবতা ও মুসলিম উম্মাহর সংহতির বার্তা হিসেবে বিবেচিত হলেও, এর আড়ালে রাজনৈতিক পুনরুত্থানের গভীর পরিকল্পনা লুকিয়ে থাকতে পারে।
ছাত্রলীগ নেতাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব উপস্থিতি
হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অনেকেই এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে বিভিন্ন উসকানিমূলক পোস্ট ও ভিডিও শেয়ার করেছেন। এসব পোস্টে সরাসরি সরকারের সমালোচনা, ভারতবিরোধী মন্তব্য এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ দেখা গেছে।
তবে এখানেই শেষ নয়—ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে লক্ষ্য করা গেছে সুপরিকল্পিত প্রচারণা, যাতে সুন্নী সমাবেশে বৃহৎ জনসমাগম ঘটিয়ে সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী মীর জাহানের প্রতিবাদ ও প্রশ্ন
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা সংশ্লিষ্ট কর্মী মীর জাহান সরাসরি এই তৎপরতার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়েছেন। শুক্রবার সকালে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে তিনি কিছু ছাত্রলীগ নেতার স্ক্রিনশট পোস্ট করে লিখেছেন:
“নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ছাত্রলীগের হবিগঞ্জ শাখার সভাপতি, সেক্রেটারি, সাবেক সেক্রেটারিরা এখন প্যালেস্টাইনের দরদী হয়ে উঠেছে! অথচ এরা ভারতের বিরুদ্ধে একটি পোস্ট করায় আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল! আজ তারা কীভাবে মুসলিমদের পক্ষ নেয়?”
মীর জাহান আরও লেখেন,
ফুলতলীর মুনাফেক এবং মাজার পূজারিদের ষড়যন্ত্র রুখে দাও বাংলাদেশ। ২৬ তারিখে যেন মাইর একটাও মাটিতে না পড়ে।”
সমাবেশে অনুমতির প্রশ্নে ধোঁয়াশা
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই সমাবেশের এখনও সরকারি অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে আয়োজকগণ বলছেন, তারা পীর-মাশায়েখ ও সাধারণ মুসলমানদের উদ্যোগে প্যালেস্টাইনের জনগণের প্রতি সংহতি জানাতে এই কর্মসূচি নিতে চাচ্ছেন। অথচ পর্দার আড়ালে একদল নিষিদ্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই সভাকে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে—যার প্রমাণ মিলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা: ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক অস্ত্রে রূপান্তর
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সরকারের নাজুক অবস্থান ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে বিরোধী শক্তির নতুন সংগঠনের খেলা শুরু হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় আবেগ ও মুসলিম উম্মাহর প্রতি সহানুভূতিকে ব্যবহার করে মাঠে ফেরার এই প্রচেষ্টা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।
তারা বলছেন, "যদি সত্যিই প্যালেস্টাইনের প্রতি সহানুভূতির বিষয় থাকে, তাহলে তা নিরপেক্ষভাবে করা হোক। কিন্তু কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন বা বিতর্কিত নেতার উপস্থিতি থাকলে সেটি আসলে আন্তর্জাতিক ইস্যুকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের নামান্তর।"
২৬ এপ্রিলের ‘সুন্নী সমাবেশ’ আপাতত ধর্মীয় ও মানবিক ইস্যু মনে হলেও, এর পিছনে রাজনীতির দীর্ঘ ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ছাত্রলীগের মতো বিতর্কিত ও নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সক্রিয়তা এই কর্মসূচিকে ঘিরে নতুন করে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সরকার যদি সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে ‘ধর্মের ছায়ায় রাজনীতি’র এই কৌশল ভয়াবহ মোড় নিতে পারে।