মোঃ হোসাইন সিপাহীঃ
জলবায়ু পরিবর্তন আজ আর দূরের কোনো হুমকি নয়—এটি আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, তাপদাহ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি—এসবই আমাদের চোখের সামনে ঘটছে। এর ভয়াবহ প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশে। দেশের মধ্যে উপকুলের জেলাগুলোতে ক্ষতির পরিমানটা অত্যাধিক ভাবে বেশি পরিলক্ষিত হয়। বরগুনা জেলা তার মধ্যে অন্যতম। এই জেলার তরুনরাও তাদের জায়গা থেকে জলবায়ূ প্রতিরোধে তৈরি করে চলছেন ভীত।
জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন বিপন্ন হবে। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের তরুণরাই আজ জলবায়ু প্রতিরোধের নেতৃত্ব নিতে শুরু করেছে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে গড়ে উঠছে সচেতনতা ,উদ্ভাবনী প্রকল্প ও সবুজ আন্দোলনের নতুন ধারা।
গত ১৬ বছরে উপকূলীয় জেলা বরগুনায় উল্লেখযোগ্য ঘূর্ণিঝড়-২০০৭ সালে ১৫ নভেম্বর সিডর, ২০০৮ সালে ৩ মে নার্গিস, ২০০৯ সালে ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালে ১৬ মে মহাসেন, ২০১৬ সালে ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালে ৩০ মে মোরা, ২০১৮ সালে ১১ অক্টোবর তিতলি, ২০১৯ সালে ৩ মে ফণী, ২০১৯ সালে ৯ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালে ২০ মে আম্ফান , ২০২২ সালে ২৫ অক্টোবরে সিত্রাং, ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বরের মোখা, ২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর হামুন, ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর মিধিলি এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৬ মে রেমাল আঘাত আনে। এ বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলো উপকূলীয় মানুষের জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি করেছে। এসময় সমুদ্রের লোনাপানি বিভিন্ন বেড়ি বাঁধ ভেঙে লোকালয়সহ ফসলের মাঠে প্রবেশ করছে। আর এ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় লাখ লাখ মানুষের বসবাসে দুর্বীষ হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লোনাপানির আধিক্য। আর নষ্ট হয়েছে সুপেয় পানি। এমন দূর্বিসহ জনজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তরুনরা এগিয়ে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে। বরগুনা সহ বেতাগী উপজেলা তরুনদের অংশগ্রহনে তৈরি হয়েছে অনেকগুলো সংগঠন তার মধ্যে অন্যতম গ্রীন পিচ ইয়ূথ ডেবলপমেন্ট সোসাইটি, তরুন কল্যান পরিষদ, উত্তর বেতাগী একতা ক্লাব। যাদের কার্যক্রমের অন্যতম দিক হলো জলবায়ূ প্রতিরোধে সচেনতা তৈরি, বৃক্ষরোপন কর্মসূচি, প্লাষ্টিক ব্যবহার বিরোধী কর্মকান্ড ইত্যাদি।
তরুনদের পাশাপাশি দেশে এখন শিক্ষার মূল ধারাতেই অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জলবায়ু শিক্ষা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ২০২৩ সালের নতুন পাঠ্যক্রমে পরিবেশ, জলবায়ু ও টেকসই উন্নয়নকে বাধ্যতামূলক উপাদান হিসেবে যুক্ত করেছে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীরা শিখছে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে, তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কী, এবং কিভাবে সচেতন জীবনযাপনের মাধ্যমে এই প্রভাব কমানো যায়।
এই শিক্ষা শুধুমাত্র তত্ত্বে সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থীরা বাস্তব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে জলবায়ু সচেতনতা অর্জন করছে—যেমন বৃক্ষরোপণ অভিযান, প্লাস্টিকবিরোধী ক্যাম্পেইন, এবং স্থানীয় জলাশয় রক্ষায় অংশগ্রহণ। অনেক প্রতিষ্ঠানে “ইকো স্কুল” উদ্যোগ চালু হয়েছে, যেখানে স্কুল প্রাঙ্গণেই তৈরি হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ চালিত আলো, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও কম্পোস্টিং প্রকল্প। সরকারের এমন শিক্ষাব্যবস্থঅর মধ্য দিয়ে বর্তমান তরুনরা উজ্জীবিত হয়ে কাজ করে চলছে প্রান্তিক পর্যায়ে । তারা সৃষ্টি করছে নতুনত্ব পদ্ধতি যার মাধ্যমে জলবায়ূ পরিবর্তন রোধে কাজ করতে পারছে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে জলবায়ু আন্দোলনের মুখপাত্ররাই তরুণ—গ্রেটা থুনবার্গের মতো কণ্ঠ আজ বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশেও একই চেতনা দেখা যাচ্ছে। রাজধানী থেকে উপকূল পর্যন্ত তরুণেরা এখন নিজেরাই আয়োজন করছে সচেতনতা মিছিল, ক্যাম্পেইন, ও স্থানীয় জলবায়ু ফোরাম। এই প্রজন্ম জানে, তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের কর্মকাণ্ডের উপর। তাই তারা শুধু অভিযোগ করছে না, সমাধানও খুঁজছে—পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, ও দায়িত্বশীল ভোক্তা আচরণের মাধ্যমে।
তরুন জলবায়ূ যোদ্ধা ও গ্রীন পিচ ইয়ূথ ডেবলপমেন্ট সোসাইটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোঃ আরিফুল ইসলাম মান্না বলেন, আমরা উপকুলীয় জেলায় বসবাস করি। জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে প্রতি বছর আমাদের জান মালের ক্ষতি হয়। পিছনের অত্যাধিক ক্ষতির অভিজ্ঞতা আমাদের ভাবিয়ে তুলে । সেই জায়গা থেকে আমরা ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক সম্মিলিত হয়ে ৪ বছর পূর্বে তৈরি করি এই সংগঠন যার প্রধান লক্ষ্য হলো জলবায়ূ পরিবর্তন বিষয়ে সচেতনতা তৈরি, প্রতিরোধ করতে করনীয় সম্পর্কে ধারনা দেওয়া। তিনি আরও বলেন, আমরা শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিনি। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীর মধ্যেও তৈরি করেছি জলবায়ূ প্রতিরোধ নেতৃত্ব।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ কেবল প্রয়োজন নয়, এটি এখন এক অপরিহার্য দায়িত্ব। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে জলবায়ু শিক্ষা, ক্লাব কার্যক্রম এবং উদ্ভাবনী প্রকল্প তরুণদের হাতে তুলে দিয়েছে নেতৃত্বের সুযোগ। তাদের চিন্তা, প্রযুক্তি, ও উদ্যমই আগামী বাংলাদেশকে করবে সবুজ, টেকসই ও জলবায়ু সহনশীল।
close
ভিডিও আপলোড করুন পয়েন্ট জিতুন!
没有找到评论



















