তিস্তা নদী ও কৌশলগত ভূরাজনীতি: চীনের দিকে বাংলাদেশ, ভারতের জন্য নতুন সংকেত
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন। এই নদী নিয়ে ভারতের একতরফা সিদ্ধান্ত, শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ রোধ, এবং বর্ষায় হঠাৎ করে বাঁধ খুলে দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও মানবিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এই সমস্যা নতুন নয়। ২০১১ সালে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি খসড়া চুক্তি তৈরি হলেও তা কার্যকর হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ৩৭.৫% এবং ভারত ৪২.৫% পানি পাওয়ার কথা ছিল। বাকি অংশ রাখা হতো পরিবেশ রক্ষার জন্য। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির অজুহাত দেখিয়ে এই চুক্তিকে আটকে দেয় ভারতের কেন্দ্র। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপ—মূলত বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার প্রতি অনিচ্ছা।
চীন যেন হঠাৎ আবির্ভূত এক বন্ধু
এই সংকটময় প্রেক্ষাপটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে চীনের অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সম্প্রতি চীন সফর করেন। সেখানে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন প্রকল্পে (Teesta River Comprehensive Management Project - TRCMP) চীনের সক্রিয় আগ্রহ প্রকাশ পায়। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে একটি চুক্তি সই হওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে চীনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি Power Construction Corporation of China পুরো প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করবে। এই পরিকল্পনার সময়সীমা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এই বিনিয়োগ শুধু নদী নিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। চীন রংপুর অঞ্চলে একটি ১০০০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে, যেটি বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে উপহার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। হাসপাতালের জন্য নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুরের মাঝামাঝি এলাকায় ১২ একর জমি বরাদ্দের কাজ এগিয়ে চলেছে।
ভারতের জন্য হুঁশিয়ারি
বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কৌশলের এই পরিবর্তন ভারতের জন্য বড় হুমকিস্বরূপ। এতদিন ভারত বাংলাদেশকে তার একচ্ছত্র প্রভাবের ভেতরে রেখেছে। কিন্তু এখন চীনের সরাসরি সম্পৃক্ততা শুধু এই প্রভাবকেই চ্যালেঞ্জ করছে না, বরং ভারতের দখলে থাকা ভূরাজনৈতিক সুবিধাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একাধিক বার্তা দিচ্ছে—বাংলাদেশ এখন আর একমুখী নির্ভরশীলতায় রাজি নয়। বরং চীনকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে নিয়ে ভারতকে সমঝোতায় বাধ্য করার চেষ্টাই এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা মানে শুধু তিস্তা নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর কূটনৈতিক ভারসাম্য বদলে দেওয়া।
নতুন বাস্তবতা, নতুন চ্যালেঞ্জ
চীনের অংশগ্রহণে বাংলাদেশের লাভ কেবল পানি বা অবকাঠামোতেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি দেশের জন্য এক ধরনের কূটনৈতিক স্বাধীনতাও এনে দিচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সমতা ও সম্মানভিত্তিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠছে। যদি ভারত এখনো সঠিক সময়ে সচেতন না হয়, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় তার ঐতিহ্যগত প্রভাব হ্রাস পেতে বাধ্য।
বাংলাদেশ এখন স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে—"আমরা আর অনুগ্রহ চাই না, আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই।" এই ঘোষণাই ভারতের প্রতি এক শক্তিশালী বার্তা: সহযোগিতা না করলে বিকল্প রয়েছে, এবং সেই বিকল্পের নাম আজ চীন।