দীর্ঘ ১৭ বছর আগে একবুক গ্লানি, মাথায় মিথ্যা মামলার বোঝা আর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। আর আজ, সেই একই বিমানবন্দরে যখন তিনি পা রাখলেন, তখন দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। লক্ষ-কোটি জনতার স্লোগানে প্রকম্পিত ঢাকার রাজপথ, ভালোবাসা আর আবেগের এক মহাকাব্যিক বরণ। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিল্লুর রহমানের ভাষায়, এটি কেবল ফিরে আসা নয়, এটি তারেক রহমানের এক ‘রাজসিক প্রত্যাবর্তন’।
তবে এই ফিরে আসা কেবল উৎসবের নয়, বরং এক বিশাল চ্যালেঞ্জ ও দায়িত্বেরও। মার্টিন লুথার কিং-এর স্বপ্নের মতো তারেক রহমানও শুনিয়েছেন এক নতুন দিনের কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো ১৭ বছরের প্রবাস জীবন কি তাকে একজন পরিপক্ক রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করেছে? তিনি কি পারবেন অতীত ও ভবিষ্যতের মেলবন্ধন ঘটাতে?
‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান’: স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু দেশে ফিরেই সংবর্ধনা মঞ্চে দাঁড়িয়ে তারেক রহমান কোনো সাধারণ রাজনৈতিক বুলি আওড়াননি। তিনি মার্টিন লুথার কিং-এর বিখ্যাত উক্তি ‘‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’’-এর আদলে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, ‘‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান’’ (I have a plan)। তিনি থেমে থাকেননি, জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। ধর্ম-বর্ণ, পাহাড়-সমতলের ভেদাভেদ ভুলে এক উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি। জিল্লুর রহমান মনে করেন, এই বক্তব্যে তারেক রহমান নিজেকে কেবল দলের নেতা নন, বরং দেশের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
নেতৃত্বের শূন্যতায় একমাত্র ‘ক্যারিশম্যাটিক’ বিকল্প? বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। শেখ হাসিনা নির্বাসনে, আর বেগম খালেদা জিয়া শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাষ্ট্র পরিচালনায় অক্ষম। অন্যদিকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা তরুণ নেতৃত্ব উদ্যমী হলেও অভিজ্ঞতার অভাবে এখনো পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। জিল্লুর রহমানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই নেতৃত্বহীনতার সংকটে তারেক রহমানই বর্তমানে একমাত্র ‘ক্যারিশম্যাটিক লিডার’। ১৭ বছর যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনিস্টার গণতন্ত্রের পরিবেশে থেকে তিনি যে রাজনৈতিক পরিপক্কতা অর্জন করেছেন, তা তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে।
তিন প্রজন্মের সেতুবন্ধন বর্তমান বিএনপির রাজনীতিতে তারেক রহমানের অবস্থানকে এক অনন্য উচ্চতায় দেখছেন বিশ্লেষকরা। জিল্লুর রহমান উল্লেখ করেন, তারেক রহমান বিএনপির তিনটি ভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা রাখেন: ১. শহীদ জিয়ার প্রজন্ম: যারা দলের প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শ ধারণ করেন। ২. বেগম জিয়ার প্রজন্ম: যারা দলকে সংহত ও শক্তিশালী করেছেন। ৩. চব্বিশের ডিজিটাল প্রজন্ম: যারা জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। এই তিন প্রজন্মের মেলবন্ধন ঘটানোর সক্ষমতা এই মুহূর্তে তারেক রহমান ছাড়া আর কারো নেই।
অতীতের ছায়া ও ভবিষ্যতের অগ্নিপরীক্ষা তারেক রহমানের সামনে সুযোগ যেমন বিশাল, চ্যালেঞ্জও তেমনই পাহাড়সম। জিল্লুর রহমান সতর্ক করে বলেন, তারেক রহমানকে অবশ্যই তার অতীতের ছায়া, বিশেষ করে ‘হাওয়া ভবন’-এর কলঙ্ক এবং বিতর্কিত ঘনিষ্ঠ বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি যদি রাষ্ট্রনায়ক হতে চান, তবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে একটি স্পষ্ট সীমারেখা টানতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো এবং পশ্চিমা বিশ্বের নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তন করাও তার জন্য এক বড় পরীক্ষা।
ত্রাণকর্তা নাকি ভারসাম্য রক্ষাকারী? বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের মানুষের কোনো ‘ত্রাণকর্তা’র প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন একজন ভারসাম্যপূর্ণ নেতার। যিনি শুনতে জানেন, প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে পারেন এবং মেরুকরণ কমিয়ে আনতে পারেন। জিল্লুর রহমানের মতে, তারেক রহমান যদি নিজেকে বদলান, পুরোনো বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসেন এবং বিশ্বনেতাদের ভাষায় কথা বলেন, তবে তিনি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি হতে পারেন। আর যদি তিনি পুরোনো পথে হাঁটেন, তবে তা হবে দেশের জন্য বিপর্যয়কর।
১৭ বছর পর মায়ের কোলে ফেরা, এভারকেয়ার হাসপাতালে অসুস্থ মায়ের কপালে চুমু খাওয়া আর লাখো জনতার ভালোবাসা—সব মিলিয়ে তারেক রহমান এখন আবেগের তুঙ্গে। কিন্তু আবেগ শেষে বিবেকের পরীক্ষায় তিনি কতটা উতরে যাবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।



















