সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের এক ফিটনেস স্টুডিওতে, আরবি সুরের তালে বেলি ড্যান্স শিখছেন ডজনখানেক নারী। রক্ষণশীল সৌদি সমাজে এই প্রাচীন নৃত্যশৈলীর চর্চা এখনো অনেকটা ‘গোপন আনন্দের’ বিষয়। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন চিত্রই উঠে এসেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে সামাজিক বিধিনিষেধ শিথিল হওয়া সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা এখনো নারীদের আত্মপ্রকাশের পথে বড় বাধা।
আরব সমাজে বেলি ড্যান্স (পেট নাচ) বহু যুগ ধরে শিল্প, বিনোদন ও চলচ্চিত্রের অংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি বিশ্বজুড়ে নারীদের কাছে কেবল বিনোদন নয়, বরং শরীরচর্চা ও আত্মপ্রকাশের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে গণ্য হচ্ছে। তবে সৌদি আরবে এর চর্চা তীব্র সামাজিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
-
নিষিদ্ধতা: সৌদি আরবে, এমনকি নারীদের জন্য আবদ্ধ কক্ষেও এই নাচ এখনো সমাজের চোখে ‘নিষিদ্ধ’ বলে ধরা হয়।
-
যৌন আবেদনময়ী ধারণা: একজন অংশগ্রহণকারী এএফপিকে বলেন, "আমরা রক্ষণশীল সমাজে বাস করি। বেলি ড্যান্সকে যৌন আবেদনময় হিসেবে দেখা হয়। কোনো পরিবার বা স্বামীই চান না, অন্য পুরুষেরা তাদের নারীকে এভাবে দেখুক।"
রিয়াদের এই নাচের ক্লাসে প্রবেশের অনুমতি পেতে এএফপিকে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। অংশগ্রহণকারী নারীদের কেউই তাদের আসল নাম প্রকাশ বা মুখ দেখাতে রাজি হননি। তাদের পরিচয় গোপন রাখার প্রধান কারণ হলো পরিবারের প্রতিক্রিয়া ও মর্যাদার প্রতি সম্মান।
-
পারিবারিক ভয়: এক নারী বলেন, "আমি পরিবারের কাউকে বলব না, কারণ তাদের মর্যাদার প্রতি সম্মান রাখছি।"
-
ভিডিও ফাঁস হওয়ার উদ্বেগ: অংশগ্রহণকারীদের প্রধান উদ্বেগ হলো, তাদের নাচের ছবি বা ভিডিও বাইরে চলে যাওয়া। এই কারণে ক্লাসের ভেতরে ফোন ব্যবহারে কঠোর নজরদারি রাখা হয়। আরেক নারী বলেন, "কেউ আমাকে রেকর্ড করে ক্ষতি করতে পারেন, এই ভয় সব সময় থাকে।"
সৌদি সমাজে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু সামাজিক বিধিনিষেধ শিথিল হয়েছে। নারীরা এখন গাড়ি চালাতে পারেন এবং মাথার আবরণ (হেড স্কার্ফ) ছাড়াও বাইরে যেতে পারেন। কিন্তু সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা এখনো সমাজের গভীরে প্রোথিত।
-
নতুন স্টুডিও: রিয়াদজুড়ে এখন নারীকেন্দ্রিক যোগব্যায়াম, বক্সিং ও বেলি ড্যান্স স্টুডিও গড়ে উঠছে, যা একসময় কল্পনাতীত ছিল। তবে পুরুষ ও নারীর আলাদা আলাদা ক্লাসের নিয়ম এখনো কঠোরভাবে মানা হয়।
-
‘ড্যান্সার’ নয়, ‘কোচ’: ক্লাসের প্রশিক্ষকরা নিজেদের ‘ড্যান্সার’ নয়, বরং ‘কোচ’ বলে পরিচয় দেন। প্রশিক্ষক ওনি বলেন, "আমরা নাচকে খেলাধুলায় রূপ দিয়েছি। সৌদিরা আনন্দ করতে ভালোবাসেন, জীবন উপভোগ করতে চান। তবে সবসময় ধর্ম ও শালীনতার সীমার মধ্যে থেকে।"
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীততত্ত্ব অধ্যাপক লিসা উরকেভিচের মতে, বেলি ড্যান্স আরব উপদ্বীপের বাইরের উৎপত্তি হওয়ায় এটি স্থানীয় নাচের চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজক। তাই অনেক পরিবার মেয়েদের এই নাচে অংশ নিতে দেয় না।
তবে, রিয়াদের এই ক্লাসগুলো কেবল শরীরচর্চা বা মানসিক চাপ দূর করার মাধ্যম নয়। এটি সৌদি সমাজে নারীদের আত্মবিশ্বাস ও শক্তি জাগিয়ে তুলতে সহায়ক হচ্ছে। প্রশিক্ষক ওনি বলেন:
"আমাদের ক্লাস কেবল ফিটনেস নয়, নারীদের আত্মবিশ্বাস ও শক্তি জাগিয়ে তুলতে সহায়ক। নাচ আমাদের একত্র করে, আমাদের ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলে।"
এই চিত্রটি স্পষ্ট করে যে, সৌদি আরবের নারীরা সরকারি বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার পরেও, নিজস্ব সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে এক নীরব সামাজিক সংগ্রামে লিপ্ত। বেলি ড্যান্স স্টুডিওগুলো তাদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান তৈরি করছে, যেখানে তারা সামাজিক মূল্যবোধ ও ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে নিজেদের আনন্দ ও স্বাধীনতা খুঁজে নিতে পারছেন।



















