স্নাইপারের গুলিতে রক্তাক্ত ‘জুলাই ছাত্র আন্দোলন’—বেঁচে থাকা যন্ত্রণার নাম জুনাইদ
তাঁর নাম গাজী মো. জুনাইদুর রহমান। বয়স মাত্র ১৯। পেশা—একজন আলিম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, টঙ্গী শাখা। কিন্তু আজ তিনি শুধু ছাত্র নন—তিনি এক বেদনাদায়ক ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী।
গত বছরের ১৮ জুলাই, ঢাকার উত্তরা বিএনএস সেন্টারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় স্নাইপারের গুলিতে গুরুতর আহত হন জুনাইদ। পুলিশ ও বিজিবির সম্মিলিত গুলিবর্ষণের শিকার হয়ে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। এখনো তার ডান হাতের তিনটি আঙুল অকেজো। চলছে নিয়মিত থেরাপি, অসহনীয় যন্ত্রণার দিনরাত।
জুনাইদ বলেন, “শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গিয়েছিলাম। কিন্তু গুলি করা হলো যেন যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছি। আমার শরীরে ঢুকে আগুনের মতো পোড়াতে শুরু করে। একের পর এক সহপাঠী রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছিল। আমিও পড়ে যাই রক্তাক্ত অবস্থায়।”
ঘটনার দিন ছিল ১৮ জুলাই। এর দুই দিন আগেই ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ, যার মৃত্যুর প্রতিবাদেই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন। উত্তরা বিএনএস সেন্টারে সেদিন শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ স্লোগান দিচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই পুলিশ ছুড়ে দেয় রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, ছররা গুলি। এরপর শুরু হয় স্নাইপার রাইফেল থেকে তাণ্ডব।
জুনাইদের দাবি, সেদিন অগণিত স্নাইপার রাইফেল থেকে গুলি চালানো হয়। একটি গুলি তার ডান হাত ভেদ করে যায়, আরেকটি তার বুকের নিচ দিয়ে ঢুকে তলপেটে আটকে যায়। “কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে প্রথমে নেওয়া হয়। এরপর কুর্মিটোলা হাসপাতালে তিনবার অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা হয়। চিকিৎসকেরা জানান, গুলিটি বিজিবির ব্যবহৃত স্নাইপার রাইফেলের।”
তিনবার অস্ত্রোপচারের পরও আজ তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। জীবন থেমে গেছে এক ভয়ংকর বাস্তবতায়। তিনি বলেন, “চিকিৎসা তো পেয়েছি, কিন্তু ভবিষ্যত? পড়ালেখা কি পারবো শেষ করতে? কাজ পাবো কোথায়? এই হাত নিয়ে আমি এখন অক্ষম একজন।”
আরও কষ্টের কথা শোনান তিনি। “৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুর্মিটোলা হাসপাতালে আহতদের দেখতে আসেন। আমার পাশে এসে বলেন, ‘বাবা কেমন আছো?’ কিন্তু যে গুলির নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি-ই যদি এসে এই প্রশ্ন করেন, তা চরম প্রহসন নয়?”
অন্য এক সরকার কর্মকর্তা তাকে তিরস্কার করে বলেন, “টঙ্গী থেকে উত্তরা এসেছো কি তামাশা করতে?”
তবে এই বিপদের সময় পাশে পেয়েছিলেন কিছু সহানুভূতিশীল মানুষ। তা’মীরুল মিল্লাত ট্রাস্ট ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতারা তার চিকিৎসার যাবতীয় খোঁজখবর ও সহায়তায় পাশে ছিলেন। তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন, “মাসুম বিল্লাহ ভাই ছুটে এসেছিলেন হাসপাতালে, এরপর এলেন মিনহাজ ভাইসহ অনেকেই। তাদের আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ আমাকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়।”
তার বাবা আনিসুর রহমান, একজন কৃষক। বাড়ি গাইবান্ধার ফুলছড়ি থানার হরিপুর গ্রামে। তিনি বলেন, “আমার ছেলেকে যারা গুলি করেছে, তারা তো সরকারী বাহিনী। শেখ হাসিনার নির্দেশে আমাদের ছেলেমেয়েদের পাখির মতো গুলি করে মারা হয়েছে। আমি জীবিত থাকতে এই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচার দেখে যেতে চাই।”
এখন জুনাইদ শুধু নিজের জন্য নয়, আন্দোলনে আহত প্রত্যেকের জন্য চাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, পূর্ণ চিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং দোষীদের বিচার। তার দাবি, “জুলাই আন্দোলনের শহীদ ও আহতদের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের জন্য চিকিৎসা, চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ আমরা দেশের জন্য, ন্যায়ের জন্য, জনগণের অধিকার রক্ষায় মাঠে ছিলাম।”
এই দাবি শুধু জুনাইদের নয়, পুরো একটি প্রজন্মের—যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। গুলি খেয়েছে, রক্ত দিয়েছে। আজ তারা বেঁচে আছে যন্ত্রণায়, প্রতিবন্ধকতায়। কিন্তু রাষ্ট্র এখনো নিরব।
জুনাইদের শরীরে এখনও গুলির ক্ষত। তার চোখে এখনও সহপাঠীদের লাশ। অথচ রাষ্ট্র তাকিয়ে আছে যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু ইতিহাস জানে—জুনাইদরা ছিল, আছে এবং থাকবে। তারা শুধু গুলি খাওয়া তরুণ নয়, তারা প্রতিবাদের প্রতীক। আজ সময় এসেছে রাষ্ট্রকে জবাবদিহির মুখোমুখি করার।



















