বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়ক হচ্ছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি শুধু একজন সামরিক শাসক নন; বরং এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় আসা, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় ঐক্য ও উন্নয়নের ভিত্তি রচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার রাজনৈতিক দর্শন একদিকে ছিল জাতীয়তাবাদনির্ভর, আবার অন্যদিকে ইসলামী মূল্যবোধ-সমৃদ্ধ। এই প্রবন্ধে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ও তার ধর্মীয় মূল্যায়ন পর্যালোচনা করা হবে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ:
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের জাতিগত পরিচয় নির্ধারণে নতুন এক দর্শন উপস্থাপন করেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এ দর্শনের মূলনীতি ছিল ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইতিহাসভিত্তিক একটি জাতীয় পরিচয় রচনা করা। তিনি বলেছিলেন:
❝আমরা কেবল বাঙালি নই; আমরা বাংলাদেশী। কারণ এই ভূখণ্ডভিত্তিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য আমাদের পরিচয় নির্ধারণ করবে।❞
(তথ্যসূত্র: জিয়াউর রহমানের ভাষণ সংকলন, ১৯৭৭-১৯৮১)
এই জাতীয়তাবাদ যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালিত্বের আদর্শের বাইরে গিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মুসলিম পরিচয় ও ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দেয়, সেখানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একপক্ষের মতে এটি ইসলামি রাষ্ট্রচিন্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তবে এক্ষেত্রে কোন কোন ইসলামী চিন্তাবিদরা একে আংশিক দ্বিমত পোষণ করেছেন।
বহুদলীয় গণতন্ত্র:
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে চালু হওয়া একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন।
১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটে তিনি ব্যাপক জনসমর্থন পান এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে পুনরায় সক্রিয় হওয়ার সুযোগ দেন। ইসলামী দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ প্রদান ছিল এই সিদ্ধান্তের বড় বৈশিষ্ট্য।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা, যেখানে মতপার্থক্যের অবকাশ থাকলেও শরয়ি সীমারেখার মধ্যে মত প্রকাশ করা যায়। কুরআনে বলা হয়েছে:
❝তাদের সব কাজ পরস্পরের পরামর্শের ভিত্তিতে হয়❞
(সূরা শূরা, আয়াত ৩৮)
এই আয়াতের আলোকে বলা যায়, জিয়াউর রহমান শুরা-ভিত্তিক শাসনের ধারণা থেকে বহুদলীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করেন।
ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা:
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামী মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেন। তিনি সংবিধানের ৮ (১) ধারা সংশোধন করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ অন্তর্ভুক্ত করেন।
এছাড়া:
ওআইসি-এর সদস্যপদ নিশ্চিতকরণ
ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি
ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে পূর্ণাঙ্গ সরকারিভাবে সক্রিয় করা
ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা, ইসলামি ব্যাংক চালু
এসব ছিল ইসলামী রাষ্ট্র পরিচয় সুসংহত করার লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপ।
ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এ সিদ্ধান্ত একটি ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার বুনিয়াদ রচনা করেছিল। তবে পূর্ণ শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সে সময় হয়নি।
উন্নয়নভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি:
‘উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র’ দর্শনে বিশ্বাসী জিয়া কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাখাত, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পায়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
‘গ্রাম হবে শহর’ এই স্লোগান দিয়ে গ্রামীন উন্নয়ন বোর্ড (BRDB), মৎস্য ও পশুসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, রাসূল (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনব্যবস্থায়ও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব ছিল জনকল্যাণ নিশ্চিত করা।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।”
এই হাদীসের আলোকে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক কার্যক্রম ইসলামের মৌলিক রাষ্ট্রদায়িত্বের অংশ। জিয়ার উন্নয়ননীতি সেই দায়িত্বের একটি বাস্তবায়ন বলা যায়।
ধর্মীয় মূল্যায়ন ও বিতর্ক:
ইসলামী চিন্তাবিদদের একাংশ মনে করেন, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ইসলামী মূল্যবোধ ও আধুনিক রাষ্ট্রশাসনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস।
অন্যদিকে, উম্মাহ ঐক্যের প্রবক্তারা বলেন, জাতীয়তাবাদ (কওমিয়্যাহ) মূলত মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের জন্য প্রতিবন্ধক।
জাতীয়তাবাদ বনাম উম্মাহ ঐক্য: সহজ বিশ্লেষণ
উম্মাহ ঐক্যের পক্ষে যারা কথা বলেন, তারা মনে করেন, জাতীয়তাবাদ (কওমিয়্যাহ) মুসলিম জাতির ঐক্যের পথে বড় এক বাধা। কারণ, এতে মুসলমানদের মাঝে ভৌগোলিক, ভাষাগত, জাতিগত বিভাজন সৃষ্টি হয়, যা ইসলাম চায় না।
তবে বিষয়টা এতটা একমুখী নয়। ইসলাম "জাতি বা দেশপ্রেম" পুরোপুরি অস্বীকার করে না। বরং যে কোনো জাতি বা দেশের মানুষ তার শিকড়, ইতিহাস ও মাটির প্রতি ভালোবাসা দেখাতেই পারে, যতক্ষণ সেটা অহংকার, অন্য জাতিকে হেয় করা বা মুসলিম উম্মাহর বিভাজনের কারণ না হয়।
জাতীয়তাবাদ দুই রকম:
১. "বৈষম্যমূলক ও বিভাজন সৃষ্টিকারী জাতীয়তাবাদ" যেখানে অন্য জাতিকে তুচ্ছ মনে করা হয় বা জাতিগত গর্বে বিভ্রান্ত হয়ে উম্মাহর ঐক্য ভেঙে ফেলা হয়, ইসলাম এটা সমর্থন করে না।
২. ন্যায়ভিত্তিক, সীমার মধ্যে থাকা স্বজাত্যবোধ ও দেশপ্রেম, যেখানে নিজের দেশ, জাতি ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসা দেখানো হয়, কিন্তু তা উম্মাহর ঐক্যের ক্ষতি করে না, ইসলাম এটা মেনে নেয়।
বাংলাদেশে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদ এই দ্বিতীয় ধরণের। তাঁর জাতীয়তাবাদ ছিল বিভেদের নয়, বরং স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য ও স্বজাত্যবোধের ভিত্তিতে, যার পেছনে ছিল ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ইসলামী ন্যায়ের ধারণা।
মহানবী (সা.) বলেন:
“দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।”
বিষয়টি যদি আমরা এককথায় বলি তাহলে-
ইসলাম উম্মাহর ঐক্য চায়, কিন্তু সীমার মধ্যে থেকে নিজের জাতি ও দেশকে ভালোবাসাও ইসলাম স্বীকৃত দেয়। বিভাজন ও অহংকার নয়, ন্যায়, ভ্রাতৃত্ব ও দায়িত্ববোধই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির মূল চেতনা। এভাবে বলতে পারি..
পাশাপাশি, অনেকে অভিযোগ করেন, তিনি সামরিক শক্তির বলে রাজনীতি ও গণতন্ত্র পরিচালনা করেছিলেন। তবে একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন ও ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, বহুদলীয় গণতন্ত্র, ইসলামী মূল্যবোধ ও উন্নয়নভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনার মিশ্রণ। তিনি একদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ইসলামি ঐতিহ্যকে মর্যাদা দিয়েছেন, অপরদিকে আধুনিক রাষ্ট্রশাসন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর অনেক পদক্ষেপ প্রশংসনীয় এবং ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলা যায়। তবে কিছু জায়গায় বিতর্ক ও মতভেদ থাকলেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি এক অনন্য রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
ওলামা দল প্রতিষ্ঠা ও জিয়াউর রহমানের সাথে আলেম-উলামাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামী মূল্যবোধ ও আলেম সমাজের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রয়োজনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ওলামা দল’। এই সংগঠনের মাধ্যমে দেশের শীর্ষ আলেম-উলামারা রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন, সমাজ সংস্কার ও ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত হন।
জিয়াউর রহমান বিশ্বাস করতেন, ইসলামী মূল্যবোধ ছাড়া একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র পূর্ণাঙ্গ মর্যাদায় দাঁড়াতে পারে না। তাই তিনি ওলামা সমাজের মতামত ও পরামর্শকে রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্ব দিতেন।
ওলামা-মাশায়েখদের প্রতি জিয়ার আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সরাসরি অংশগ্রহণের বহু দৃষ্টান্ত ইতিহাসে রয়েছে। ওলামা-মাশায়েখদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও ইসলামী কার্যক্রমে সহযোগিতার জন্য তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে সরকারিভাবে শক্তিশালী করেন, ইসলামি ব্যাংক, ইসলামি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর আমলেই ওলামা-মাশায়েখগণ রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ ও জাতীয় সংসদের নির্বাচনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুযোগ লাভ করেন। এর ফলে, আলেম-উলামাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক দৃঢ় হয় এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থী শক্তি একটি সাংগঠনিক ভিত্তি লাভ করে।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক রাষ্ট্র চিন্তা ও আলেম-উলামাদের সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করার প্রয়াস এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। তাঁরই হাতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী ওলামা দল আজও এই দর্শনকে ধারণ করে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছে।
লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা।



















