ঢাকা: রাজউকের ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের মাধ্যমে আবারও আলোচনায় এসেছে বিতর্কিত প্লট বরাদ্দের বিষয়। বিশেষত, শেখ হাসিনার আওতাধীন সরকারের শেষ সময়কালে, সরকারি চাকরি, জনসেবা ও জাতীয় অবদানের নাম দিয়ে ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে বহু ব্যক্তি প্লট পেয়েছেন—যার মধ্যে বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের সমর্থক, অনুগত কিংবা বিতর্কিত। রাজনৈতিক প্রভাব, তোষামোদ, এবং আনুগত্যের ভিত্তিতে এ প্লট বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি দেশজুড়ে আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি করেছে।
এই বিতর্কের একেবারে সামনের কাতারে রয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান। ২০১৩ সালে তিনি ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের সংরক্ষিত কোটায় ৩ কাঠার প্লট পেয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। ২০২১ সালে নিজের মেয়াদ শেষে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ১৩৭ জনকে নিয়োগ দেন, যা পরবর্তীতে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
তবে প্লট বরাদ্দের ব্যাপারে অভিযোগ কেবল এখানেই থেমে নেই। ঝিলমিল প্রকল্পে অসামান্য অবদান দেখিয়ে ২০৬টি প্লট বরাদ্দের তথ্য পাওয়া গেছে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের তোষামোদকারী ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। অধিকাংশ প্লটের মালিকরাই বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সরকারী কর্মকর্তা, সরকারি চাকরিজীবী, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাংবাদিকরা।
এই ঘটনাগুলি প্রমাণ করে, ঝিলমিল প্রকল্পের প্লট বরাদ্দ মূলত রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক অনুগতরা নিজেদের জন্য ‘অসামান্য অবদানের’ পুরস্কার হিসেবে প্লট পেয়েছেন। কয়েকটি সংবাদ প্রতিবেদনও এটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে, যেখানে দাবি করা হয়েছে, রাজউকের মাধ্যমে প্লট বরাদ্দে ‘অনুগতদের’কেই মূলত পুরস্কৃত করা হয়েছে। বিশেষত, ২০ জানুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই ধরনের ৮৩০ জন প্লটের মালিক হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে।
অথচ, সাধারণভাবে আলোচনা করলে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ‘অনুগত’দের মাঝে এমন প্লট বরাদ্দ দেওয়া সামাজিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। এতে ক্ষোভের শিকার হয়েছে দেশের দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে খ্যাতিমান ব্যক্তিরা।
এছাড়া, রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান ১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রাজউকের কাজ হলো উপরে থেকে আসা নির্দেশনা পালন করা। তিনি জানান, যে সমস্ত ব্যক্তি প্লট পেয়েছেন, তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে এবং আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি কমিটি বিষয়টি পর্যালোচনা করছে।
শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যই নয়, আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী দলের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম ঝিলমিল প্রকল্পের প্লট বরাদ্দের তালিকায় উঠে এসেছে। এর মধ্যে আছেন সরকারি চাকরিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, আইনজীবী, গৃহিণী, সমাজসেবক, ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকরা। একেবারে উচ্চপর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পর্যন্ত এই তালিকায় রয়েছেন।
তবে এখন প্রশ্ন উঠেছে, কেন এসব প্লট দেওয়া হলো? কিছু প্লট যোগ্য ব্যক্তিদের দেয়া হলেও অধিকাংশ প্লট বিতরণ করা হয়েছে ‘অনুগত ও তোষামোদকারীদের’কে। রাজনৈতিক সমর্থন ও আনুগত্যের ফলস্বরূপ তাদের এসব ‘উপহার’ দেওয়া হয়েছে—এটি বাস্তবতা।
শেখ হাসিনার সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে এই প্লট বিতরণ ব্যবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে। প্রায় ৮৩০টি প্লট অসামান্য অবদানের নামে দেওয়া হয়েছে, যেখানে সবচেয়ে বেশি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্যরা। পাশাপাশি, ২২ মন্ত্রী, ১২ প্রতিমন্ত্রী ও ৩৯ জন সচিবও এই সুবিধা পেয়েছেন।
এদিকে, ঝিলমিল প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের পদ্ধতি দুটি ছিল—লটারির মাধ্যমে এবং ১৩/এ ধারায় অসামান্য অবদানের জন্য। যদিও লটারির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দের ব্যাপারে ২০০৯ সালের পর কোনো বিজ্ঞপ্তি হয়নি, ১৩/এ ধারায় বেশ কিছু ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে, যাদের প্লট বরাদ্দ হয়েছে।
এ ধরনের বিতর্কিত প্লট বরাদ্দের ঘটনা রাষ্ট্রের নীতি, গণতন্ত্র ও শাসন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করতে পারে, এবং এর ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটতে পারে।
অতএব, রাজউক ও সরকারকে এই বিষয়গুলো যথাযথভাবে তদন্ত এবং প্রকাশ করা উচিত, যাতে দেশের জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়।
कोई टिप्पणी नहीं मिली