মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করে। গত বছর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে এই দণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই মামলায় শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মাত্র চার মাস সাতদিনের মধ্যে এই মামলার রায় দেওয়া হলো, যার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছিল গত ১০ই জুলাই অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে। দ্রুততম সময়ে এই রায় আসায় ইতিমধ্যেই তা দেশে-বিদেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ কর্তৃক রায় প্রত্যাখ্যান ও আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ
রায় ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। দলটির প্রধান শেখ হাসিনা এই রায়কে ‘পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে, এই রায় ঘিরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এই বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের বিবৃতিতে বলেছে, অভিযোগ গঠন থেকে মাত্র চার মাসের মধ্যে এই রায় এসেছে। তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে শেখ হাসিনার মামলার বিচার এবং রায় হওয়া উচিত ছিল।
রাজনীতিতে 'আওয়ামী লীগ বনাম অ্যান্টি আওয়ামী লীগ' মেরুকরণ বৃদ্ধি
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে এবং নতুন মেরুকরণ তৈরি করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, এই রায়ের ওপর নির্ভর করে দেশে 'আওয়ামী লীগ ও অ্যান্টি আওয়ামী লীগ' এই রাজনীতিটা আরও নিষ্ঠুরতার দিকে যাবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি রায়ের মধ্যে কোনো ফাঁকফোকর থেকে থাকে, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়বে।
অধ্যাপক আহমেদ আরও উল্লেখ করেন, বিচারে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ না করা হলে দেশের রাজনৈতিক বিভেদ আরও বাড়বে এবং পোলারাইজেশনের এই রাজনীতি চলমান থাকবে। তিনি ধারণা করছেন, এর ফলে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। তবে, তিনি মনে করেন না যে এই কারণে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথে আইনি বাধা
গত বছর অক্টোবরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আনা একটি সংশোধনী অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেই ব্যক্তি জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ বিচার শেষে রায়ও হয়েছে। ফলে ট্রাইব্যুনালের সংশোধনী অনুযায়ী, শুধু শেখ হাসিনাই নন, বরং দলটির অন্য যেসব নেতার বিরুদ্ধে কেবল আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে, তাদের কেউই আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। অধ্যাপক সাব্বির আহমেদের মতে, এ রায়ের ফলে দল হিসেবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান আগের চেয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব ও ভারতের ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবায়দা নাসরীনের মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে অনেক সময় আন্তর্জাতিক প্রভাব বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মিয়ানমার, চীন, ও রাশিয়া—এই প্রতিবেশি শক্তিগুলো কীভাবে তাদের মনোযোগ ও কার্যকারিতা রাখছে, তার ওপর বাংলাদেশের রাজনীতি নির্ভর করে বলে মনে করেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, শেখ হাসিনার রায়কে ঘিরেও আন্তর্জাতিক মহলের চাপ, তাপ এবং প্রভাব থাকবে। জোবায়দা নাসরীনের মতে, এই রায় ঘিরে ভারতের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হয় কি না, তার ওপরেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির অনেক কিছু নির্ভর করবে।
দেশে ফেরা ও রাজনৈতিক উত্থানের গুঞ্জনে অবসান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের পরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা বা উত্থান এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের বিষয়ে যে গুঞ্জন ছিল, এই রায়ের ফলে তার অবসান ঘটেছে।
তিনি মনে করেন, এই রায়ে ভারতের জন্য একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যদিও তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল একেবারে সাদামাটা। মাসুম আরও মনে করেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারতের যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখন সীমিত হয়ে যাবে। তার মতে, মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়ায় শেখ হাসিনার খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হওয়া বা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করার সম্ভাবনা সীমিত হয়ে যাবে।
নৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে বিরোধী পক্ষ
অধ্যাপক মাসুমের সামগ্রিক বিশ্লেষণ হলো, “ওভারঅল বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অবস্থান আরো দুর্বল হবে এবং তার বিরোধী পক্ষ এই রায়ের মধ্য দিয়ে নৈতিকভাবে বা রাজনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী হবে।”
শেষের লাইন শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের এই রায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতি, আগামী নির্বাচন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন ও কঠিন অধ্যায়ের সূচনা করল, যার ফলশ্রুতিতে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা আগামী দিনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।



















