ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে আসেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস। এই সরকার আসার কিছুদিন পর ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়।
আমার প্রশ্ন হলো—আওয়ামী লীগ এমন একটি রাজনৈতিক দল, যার লক্ষাধিক নয়, কোটি কোটি কর্মী-সমর্থক রয়েছেন। এদের অনেকেই কোনো ধরণের লুটপাট, খুনখারাবির সঙ্গে যুক্ত নয়। কেউ কৃষক, কেউ দিনমজুর, কেউবা রিকশাচালক—যাদের জীবনের বাস্তবতা এতটাই কঠিন যে, গত দুই-তিন বছরে হয়তো টিভির সামনে বসে খবর দেখার সুযোগ পর্যন্ত হয়নি, সোশ্যাল মিডিয়া তো বহু দূরের কথা।
এই বর্তমান সময়ে, টেলিভিশন, রেডিও ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—এই কয়েকটি মাধ্যমই সাধারণ জনগণের কাছে তথ্য পৌঁছানোর প্রধান হাতিয়ার। এই মাধ্যমগুলোই একজন সাধারণ মানুষকে রাতারাতি মহান করে তুলতে পারে, আবার একজন মহান ব্যক্তিকে রাস্তায় নামিয়ে দিতে পারে। চাইলে একটি দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংস করা যায়, আবার চাইলে উজ্জ্বলভাবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা যায়। অথচ বাস্তবতা হলো, দেশের খেটে খাওয়া মানুষেরা এসব মাধ্যম থেকে ক্রমেই দূরে সরে গেছে। কারণ তাদের মূল লক্ষ্য—তিন বেলা খেয়ে বাঁচা।
তারা জানে না, আওয়ামী লীগ গত ১৬-১৭ বছরে কী ধরনের অপরাধে যুক্ত ছিল। শেখ হাসিনা ও তার চারপাশের কিছু চাটুকার নেতা-নেত্রীর নির্দেশে কতজন ছাত্র, কতজন সাধারণ মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে—তারা জানে না। দেশের অসংখ্য সূর্যসন্তান বছরের পর বছর ‘আয়না ঘর’ নামক গোপন নির্যাতনকেন্দ্রে নির্যাতিত হয়েছে—এসব খবরও তারা জানে না।
এ অবস্থায় প্রশ্ন আসে—আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা যদি আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেন, তাহলে কি সত্যিই তারা প্রমাণ করতে পারবেন যে এই দলটিই একমাত্র অপরাধী? শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিপরিষদের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো হয়েছে, সেসব তো বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও এক সময় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হয়েছিল। হাজার হাজার মামলা ছিল বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে, আজ তারা বেশিরভাগই খালাসপ্রাপ্ত। কেউ কেউ এখন বলছেন—তারা রাজনৈতিক হয়রানির শিকার ছিলেন।
কিন্তু এই খালাসপ্রাপ্তদের মধ্যে কি কেউই চাঁদাবাজ, লুটেরা বা প্রতারক ছিলেন না? নিশ্চয়ই ছিলেন। তবুও তারা আজ ফুলের মালা পরে হাওয়া খাচ্ছেন। যখন আবার আওয়ামী লীগ ফিরবে, তখন কি ঠিক একইভাবে তাদের মামলাগুলো রাতারাতি বাতিল হয়ে যাবে না? তারা কি আবার মাঠে-ঘাটে লুটপাট শুরু করবে না?
সুতরাং, কোনও রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। বরং দরকার হল—সুশৃঙ্খল ও নিরপেক্ষ বিচার। আওয়ামী লীগ যখন ১৬-১৭ বছর ক্ষমতায় ছিল, তখন যারা দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন, খুন ধর্ষণে জড়িত ছিলেন, দেশের টাকা পাচার করেছেন—তাদের বিচার করুন। সেই বিচার জনসমক্ষে করুন। খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে সেই বিচারের তথ্য পৌঁছে দিন। তাদের দেখান কে কী অপরাধ করেছে, কাদের কারণে দেশের এই অবস্থা হয়েছে।
যেমন ধরুন, আওয়ামী লীগের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে—তাদের বিচার করে সংসদ ভবনের সামনেই ফাঁসি কার্যকর করুন। তখন সাধারণ মানুষ নিজের চোখে দেখবে কাকে এতদিন ভালোবেসেছিল, কার হাতে দেশ তুলে দিয়েছিল। তখন এই দলের কর্মীরাই একে একে সরে দাঁড়াবে, দল নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হবে না।
আজ সাধারণ মানুষ এই বিশ্বাসে পৌঁছেছে যে—যা কিছু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হচ্ছে, তা একটি রাজনৈতিক নাটক, প্রতিশোধমূলক হয়রানি। এই বিশ্বাস ভাঙার একমাত্র উপায় হলো—সুষ্ঠু বিচার। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, সত্যিকারের জবাবদিহি চাই। যারা রাষ্ট্রের অর্থ চুরি করেছে, যারা দেশের মানুষকে নির্যাতন করেছে—তাদের একে একে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করান।
মাসে অন্তত একবার সাধারণ মানুষের সাথে সরাসরি কথা বলুন, তাদের প্রশ্নের জবাব দিন, তাদের মতামত শুনুন। এই বিচার এবং গণতান্ত্রিক যোগাযোগের মধ্য দিয়েই মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে তারা কার পাশে থাকবে, কাকে ভোট দেবে, কাকে বর্জন করবে।
তবেই দেশ বাঁচবে। তবেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে। দল নয়, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। দল নয়, অপরাধকে নির্মূল করুন।
লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন