বাংলাদেশের বিচারিক প্রক্রিয়ায় রিমান্ডের ব্যবহার বরাবরই বিতর্কিত বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে যাত্রাবাড়ী থানার হত্যা মামলায় চার দিনের রিমান্ডে পাঠানোর ঘটনায় এ বিতর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। আদালতে তার আইনজীবীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মামুনের প্রতিক্রিয়া—“বেশি কথা বলায় একদিন রিমান্ড বেড়েছে”—দেশের বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
সাবেক পুলিশপ্রধানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক ভুক্তভোগী মো. সায়েম হোসেন হত্যার সঙ্গে জড়িত। অভিযোগ অনুসারে, ২০২৩ সালের ১৯ জুলাই মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সায়েম। তার মা শিউলি আক্তার ২৭ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এরপর ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী থেকে মামুনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ এবং দফায় দফায় তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। সর্বশেষ, ৮৫ দিন রিমান্ডে থাকার পরও আবার নতুন করে চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে, যা বিচার ব্যবস্থার উপর রাজনৈতিক চাপের ইঙ্গিত বহন করতে পারে।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় রিমান্ডের অপব্যবহার ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও তাদের রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়টি বিচারিক ব্যবস্থার রাজনৈতিক ব্যবহারের এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, দীর্ঘদিন পুলিশপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা একজন ব্যক্তিকে একাধিক দফায় রিমান্ডে নেওয়ার যৌক্তিকতা কী? রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী শুনানিতে বলেছেন, “চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন পুলিশের সর্বোচ্চ দায়িত্বে ছিলেন এবং তিনি নির্দেশ মতো দায়িত্ব পালন করেছেন।” তবে এই বক্তব্য কি তার দায় এড়ানোর যথেষ্ট কারণ হতে পারে?
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো রিমান্ডের অপব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়াকে সংবিধানবিরোধী এবং নির্যাতনমূলক বলে দাবি করে আসছে। আন্তর্জাতিক মহলেও এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
যদি রিমান্ডের উদ্দেশ্য হয় প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা, তবে কেন এত দীর্ঘ সময় পরও মামুনের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়নি? এটা কি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ, নাকি প্রকৃত বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া?
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দীর্ঘদিন ধরে আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। বিরোধীদের দমন করতে বিচারিক প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করার অভিযোগ নতুন নয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ কি শুধুই আইনি, নাকি এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে? একই সঙ্গে, বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার প্রশ্নে সাধারণ নাগরিকদের আস্থা কতটা টিকে থাকবে?
সাবেক আইজিপি মামুনের রিমান্ড নিয়ে বিতর্ক আরও গভীর হয়েছে তার নিজের মন্তব্যের কারণে। বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে যেকোনো ধোঁয়াশা জনগণের আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার, বিচার বিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে মামলাটি পরিচালনা করা। অন্যথায়, এটি শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে নয়, বরং সামগ্রিক বিচারিক ব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।