বাংলাদেশ বর্তমানে যে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা করছে তা বিশ্বব্যাপী মানবিক ইস্যু হলেও এর ভেতরে আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য, দ্বৈত কূটনীতি এবং জিও-স্ট্র্যাটেজিক জটিলতা গভীরভাবে জড়িত। ২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর পরিচালিত দমন-পীড়নের পর প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তবে এত বছরের মাথায়ও তাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হয়নি। বরং, বাংলাদেশ একটি মানবিক করিডোর খুলে দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা পেলেও, এর ফলে ভবিষ্যতে এককভাবে এই সংকটের দায় কাঁধে তুলে নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গা সংকটকে ‘গণহত্যা’ বলে চিহ্নিত করলেও, এর প্রতিকারমূলক নীতিতে তারা কার্যত নিষ্ক্রিয়। জাতিসংঘের রেজোলিউশনে ভোটাভুটির সময় ভারত ও চীন প্রকাশ্যে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। চীন বরং মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মধ্যপন্থী ‘সমঝোতা’র পক্ষে থেকেছে। ভারত মিয়ানমারকে নিরাপত্তাগত অংশীদার হিসেবে দেখে এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের চাপে রাখাকে কৌশলগত সুবিধা মনে করে।
মিয়ানমার নিজেই আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অস্বীকার করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। তারা জাতিগত সহিংসতার দায় অস্বীকার করছে এবং সীমান্তে সংঘর্ষে উসকানি দিচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘবদ্ধ অপরাধচক্র, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, এবং জঙ্গি সংগঠনের উত্থান দিন দিন বাড়ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (ARSA) ও জাবহাতুল আখতার ইসলামির মতো দলগুলো সক্রিয়। এসব গোষ্ঠীর উত্থান শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই একটি নিরাপত্তা হুমকি।
আরাকান আর্মির অবস্থানও জটিল। যদিও তারা মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত, তারা রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কখনো সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষ নেয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় তাদের নাম জড়িয়েছে। তারা বাংলাদেশের সাথে ভবিষ্যতে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের ইঙ্গিত দিলেও, তাদের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে স্পষ্ট কোনো কর্মসূচি এখনো সামনে আসেনি।
এই প্রেক্ষাপটে, মানবিক করিডোর খোলা মানে শুধু শরণার্থী ঢুকিয়ে নেওয়া নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক সংকটকে নিজেদের ঘাড়ে তুলে নেওয়া। এটি আন্তর্জাতিক মহলের দায় এড়ানোর সুযোগ তৈরি করে, এবং প্রতিবেশী শক্তিগুলোকে কৌশলগত সুবিধা দেওয়ার পথ প্রশস্ত করে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উচিত ছিল জাতিসংঘে একটি শক্ত অবস্থান নেওয়া, ভারত-চীনকে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক আলোচনায় বাধ্য করা, এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য একটি সুসংগঠিত কৌশলগত পরিকল্পনা উপস্থাপন। এর পরিবর্তে, মানবিক করিডোরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকেই একটি অস্থায়ী নয়, স্থায়ী সংকটক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকট এখন আর কেবল একটি মানবিক সমস্যা নয়—এটি একটি রাজনৈতিক, নিরাপত্তাগত ও ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র। এই যুদ্ধে মানবিকতা দেখাতে গিয়ে যদি কৌশলগতভাবে দুর্বল পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই ভুলের খেসারত দিতে হবে অনেক বছর।
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট একটি মানবিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। মানবিক করিডোরের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক দায় এড়ানোর পথ খুলে দিয়েছে এবং প্রতিবেশী শক্তিগুলোর কৌশলগত সুবিধা নেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। জাতিসংঘ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের নীতিগত অবস্থান, আরাকান আর্মির সংশ্লিষ্টতা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগতভাবে চরম ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। কার্যকর সমাধানের জন্য একটি দৃঢ় ও সুসংহত কূটনৈতিক কৌশল জরুরি।
—বখতিয়ার শামীম