বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে "হত্যাকাণ্ড" কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং এটি ক্ষমতার এক একটি সোপান। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে এই প্রতিবেদনের মূল অনুসন্ধান হলো—কেন এই হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশই তৃণমূলের সাধারণ কর্মী এবং কীভাবে এই মৃত্যুগুলো একটি সুপরিকল্পিত "রাজনৈতিক অর্থনীতি"র অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১. দাবার ঘুঁটি: কেন শুধু কর্মীরাই প্রাণ হারান?
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে সংঘটিত তৃণমূলের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৮০ শতাংশই ঘটেছে স্থানীয় সম্পদ (বালুমহাল, হাটবাজার, টেন্ডার) নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে। এখানে "আদর্শ" কেবল একটি ঢাল। শীর্ষ নেতারা যখন নিরাপদ দূরত্বে থেকে নির্দেশনা দেন, তখন মাঠ পর্যায়ে কর্মীরা একে অপরের মুখোমুখি হয়।
পেশি শক্তির পুনরুৎপাদন: প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর এলাকায় যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়, তা পরবর্তী নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে সাহায্য করে।
বিনিময়যোগ্য জীবন: অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বড় কোনো নেতার অপরাধ আড়াল করতে বা জনদৃষ্টি সরাতে তৃণমূলের কোনো কর্মীকে বিসর্জন দেওয়া হয়, যাকে স্থানীয় ভাষায় "বলির পাঁঠা" বলা হয়।
২. বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও "সমঝোতা"র রাজনীতি
তৃণমূলের হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার হার উদ্বেগজনক। অনুসন্ধানে তিনটি প্রধান কারণ বেরিয়ে এসেছে:
মামলা প্রত্যাহার: রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার করার একটি দীর্ঘ ইতিহাস বাংলাদেশে রয়েছে। ফলে খুনিরা জানে, দল ক্ষমতায় থাকলে তাদের কিছুই হবে না।
পরিবারের ওপর চাপ: নিহতের পরিবারকে আর্থিক প্রলোভন বা প্রাণের ভয়ে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে খুনি এবং ভিকটিম একই রাজনৈতিক দলের উপ-দলের সদস্য হওয়ায় বিষয়টি "পারস্পরিক সমঝোতা"র মাধ্যমে ধামাচাপা দেওয়া হয়।
তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাব: স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের ইশারায় চার্জশিট থেকে মূল অভিযুক্তদের নাম বাদ দেওয়ার ঘটনা এখন একটি ওপেন সিক্রেট।
৩. নতুন বিষবৃক্ষ: "কিশোর গ্যাং" ও রাজনৈতিক ব্যাকআপ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ধরনে বড় পরিবর্তন এসেছে। এখন আর পেশাদার খুনি নয়, বরং স্থানীয় কিশোরদের রাজনৈতিক প্রটেকশন দিয়ে খুনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সস্তা শ্রম: কিশোরদের অল্প টাকায় বা স্রেফ "বড় ভাই" হওয়ার লোভে এসব অপরাধে জড়ানো হচ্ছে।
আইনি সুবিধা: কিশোর অপরাধী হওয়ায় তারা বিচার ব্যবস্থায় কিছুটা শিথিলতা পায়, যা রাজনৈতিক মাস্টারমাইন্ডরা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।
৪. উত্তরাধিকার হিসেবে ঘৃণা
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এই হত্যাকাণ্ডগুলো সমাজ ও পরিবারের মধ্যে স্থায়ী শত্রুতা তৈরি করছে। বাবার খুনের বদলা নিতে ছেলে বড় হয়ে রাজনীতিতে আসছে এবং চক্রটি চলতে থাকছে। এটি বাংলাদেশের গ্রামগুলোকে একেকটি বারুদের স্তূপে পরিণত করেছে।
উপসংহার
বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কেবল আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নয়, এটি একটি পদ্ধতিগত সমস্যা। যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনীতিকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখা হবে এবং বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা না যাবে, ততক্ষণ এই রক্তের ধারা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তৃণমূলের এই কর্মীরা কোনো আদর্শের জন্য নয়, বরং এক শ্রেণির নেতার ক্ষমতার লোভের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে মহাকালের গর্ভে।
close
লাইক দিন পয়েন্ট জিতুন!
Ingen kommentarer fundet



















