close

ভিডিও দেখুন, পয়েন্ট জিতুন!

রেলপথে যুগান্তকারী বিপ্লব: আধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত দেশের দীর্ঘতম যমুনা রেলসেতু উদ্বোধনে নতুন দিগন্তের সূচনা..

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
বিশ্বমানের স্টিল প্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক অবকাঠামোর সমন্বয়ে নির্মিত যমুনা রেলসেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল সংযোগে গতি, নিরাপত্তা ও সময় সাশ্রয়ের এক নয়া অধ্যায় শুরু হয়েছ..

এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে দেশের রেলপথে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত দেশের দীর্ঘতম ডাবল ট্র্যাক, ডুয়েলগেজ রেলসেতু আজকের এই শুভ সকালের আলোকে সজীব করে তুলেছে দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে। এই সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম, যিনি পায়রা ও বেলুন উড়ানোর রঙিন পরিবেশের মধ্য দিয়ে সেতুটির উদ্বোধন করেন।

সকালের শুভ আভায়, সেতু পূর্ব ইব্রাহিমাবাদ স্টেশন এলাকার পরিবেশ এক বিশেষ উৎসবমুখর রূপ নেয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের রেল যোগাযোগ আরও নিরবচ্ছিন্ন ও দ্রুত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ঢাকার সাথে সংযুক্ত হবে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, যেখানে এই সেতুর মাধ্যমে ব্যবসায়িক, যাত্রী ও সেবার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

রেলওয়ের মহাপরিচালক এম. আফজাল হোসেন সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিদেশী অতিথিদের উপস্থিতি বিশেষ নজরকাড়া। ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনিচি এবং জাপানের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা) এর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মহাপরিচালক ইতো তেরুয়ুকি উপস্থিত ছিলেন, যারা আধুনিক প্রযুক্তি ও রেলসেতুর স্থায়িত্বের গুরুত্বকে আরও তুলে ধরেন।

প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ও স্থায়িত্বের অঙ্গীকার

সেই আধুনিক স্টিল প্রযুক্তির অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ডাবল লাইন ডুয়েলগেজ সেতু, ৫০টি পিলার ও ৪৯টি স্প্যানের সমন্বয়ে নির্মিত। ডিজাইনের প্রতিটি খুঁটিনাটি এমনভাবে পরিকল্পিত করা হয়েছে যাতে সেতুটি শত বছরেরও বেশি স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা দেয়। বাংলাদেশ রেলপথের এই নতুন সেতু শুধু মাত্র যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে নয়, সমগ্র দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে এক নতুন প্রেরণা যোগাবে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম জানিয়েছেন, "যমুনা রেলসেতুর মাধ্যমে ট্রেন পারাপারের সময় যথেষ্ট কমে যাবে। দুই পাশে সময় সাশ্রয় হবে, যা যাত্রাপথকে আরও কার্যকর ও আধুনিক করে তুলবে।" তিনি আরও উল্লেখ করেন, "ডাবল লেন সুবিধা অর্জনের জন্য আমরা অতিরিক্ত কাজ করছি, তবে প্রথম পর্যায়ে এই সেতুটি দেশের রেল যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।"

গতির নতুন মাত্রা ও যান্ত্রিক উৎকর্ষ

বাংলাদেশ রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার তানভীরুল ইসলাম জানিয়েছেন, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার সেতুর রং রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তাকেও কমিয়ে দেবে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ভবিষ্যতে রেলসেতুর রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া হবে আরও সহজ ও কার্যকর। ইব্রাহিমাবাদ রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার শাহীন মিয়া কালবেলাও জানান, "সেতু দিয়ে ট্রেন এখন ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করতে পারবে। তবে উদ্বোধনের দিন থেকে প্রথম পর্যায়ে ৯০ কিলোমিটার গতিতে চলবে, যার ফলে যাত্রাপথে প্রায় সাড়ে ৩ মিনিট সময় সাশ্রয় হবে।"

এবারের এই উদ্যোগে দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় এনে দিচ্ছে যুগান্তকারী পরিবর্তন, যা শুধু যাত্রীদের সময় বাঁচাবে না, ব্যবসায়িক চলাচলকেও করবে ত্বরান্বিত। ঢাকার সঙ্গে দেশজুড়ে দ্রুতগতির রেল যোগাযোগের ফলে দেশের অর্থনৈতিক ও শিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিনিয়োগ ও অর্থায়নের কাহিনী

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে যখন প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন ও সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রথমে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকায় ধরা হয়, তখন সৃষ্ট হয়েছিল এক নতুন স্বপ্নের ঝলক। সময়ের সাথে সাথে প্রকল্পের পরিধি ও গুণগত মান বৃদ্ধির কারণে নির্মাণ ব্যয় ২ বছর বাড়ানোর পর ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় পৌঁছে যায়। এতে উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা যায়, ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ দেশের নিজস্ব অর্থায়ন ও ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এর ঋণের সমন্বয়। এই বিনিয়োগ শুধু দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে নয়, প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।

ইতিহাস ও প্রয়োজনের মেলবন্ধন

১৯৯৮ সালে যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটলের সমস্যা দেখা দিলে ট্রেনের গতি কমিয়ে দিতে হয়েছিল। প্রতিদিন প্রায় ৩৮টি ট্রেন পারাপারের এই সেতুতে সমস্যার সমাধান করতে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেলসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।

২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি এই সেতুর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর ২০২১ সালের মার্চ মাসে পিলার নির্মাণের জন্য পাইলিং কাজ শুরু হয়। আজকের এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই দীর্ঘ সময় ধরে চলা প্রকল্পের সফল সমাপ্তি ও এর আধুনিক ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে উদযাপন করা হয়েছে।

দেশের উন্নয়নে প্রভাব ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

এই সেতুর উদ্বোধন দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার বহন করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যমুনা রেলসেতুর মাধ্যমে শুধুমাত্র যাত্রী পরিবহনেই নয়, ভারী মালবাহী পরিবহনের ক্ষেত্রেও সময় সাশ্রয় ও খরচ কমবে। ঢাকার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সংযোগ আরও সুগম হলে, ব্যবসায়িক, শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নতি সম্ভব হবে।

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় নির্মিত এই সেতু দেশের রেলপথের পরবর্তী উন্নয়নের জন্য এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। দেশের নাগরিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চিতভাবে এর সুফল গ্রহণ করবে, যা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এক বিশেষ অবদান রাখবে।

বর্তমান যুগের প্রগতিশীল অবকাঠামো প্রকল্প হিসেবে এই সেতু দেশের ইতিহাসে এক আলাদা অধ্যায় হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে কেবল রেল যোগাযোগের সুবিধা বৃদ্ধি পাবে না, বরং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মেলবন্ধন দেশের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়বে।

উদ্বোধনের সাথে সাথেই দেশের রেলপথে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে – যেখানে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় নিরাপদ, দ্রুত ও নিরবচ্ছিন্ন যাত্রী পরিবহন নিশ্চিত হবে। এদিকে, ভবিষ্যতে আরও উন্নত মানের ডাবল লেন সুবিধার যোগে দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা হবে আরো বিস্তৃত ও কার্যকরী, যা দেশের সকল নাগরিকের জীবনযাত্রাকে করবে সহজতর ও গতিশীল।

এই অসাধারণ রেলসেতু শুধু দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের গল্প নয়, বরং আমাদের জাতীয় স্বপ্ন ও সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হবে। নতুন সেতুর উদ্বোধন আমাদের দেশের রেল যোগাযোগে কেবল একটি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা নয়, বরং এক নতুন আশা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেবে।

আজকের এই বিশেষ মুহূর্তে, দেশের রেলপথে যে পরিবর্তন আসছে তা শুধুমাত্র যাত্রাপথের পরিবর্তন নয়, বরং দেশের সার্বিক উন্নয়নের এক অন্যতম মাইলফলক। ঢাকার সঙ্গে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোকে আরও দ্রুত সংযুক্ত করতে এই সেতু ভূমিকা রাখবে, যা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।

সমগ্র দেশের জন্য এই সেতু এক নতুন আশার আলো হয়ে উঠছে, যা আগামি দিনে দেশের উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়বে। দেশের রেল যোগাযোগের ইতিহাসে আজকের এই দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে – এক নতুন প্রযুক্তি, এক নতুন দিগন্ত এবং এক নতুন ভবিষ্যতের সূচনা হিসেবে।


এইভাবে, যমুনা নদীর ওপর নির্মিত দেশের দীর্ঘতম রেলসেতুর উদ্বোধন দেশের রেলপথে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। আধুনিক প্রযুক্তি, স্থায়িত্ব এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মেলবন্ধনের প্রতিফলনে, এই সেতু আমাদের দেশের রেল যোগাযোগকে করে তুলবে আরও সুগম, দ্রুত ও নিরাপদ।

No se encontraron comentarios