close

ভিডিও আপলোড করুন পয়েন্ট জিতুন!

রায়, রুটি ও বলের ত্রিমুখী লড়াইয়ে বাংলাদেশ

আই নিউজ বিডি ডেস্ক  avatar   
আই নিউজ বিডি ডেস্ক
একদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড; অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন 'রুটি-রুজি'র সংগ্রাম।..

আজকের বাংলাদেশ এক অদ্ভুত স্থবিরতা এবং একইসাথে এক প্রচণ্ড গতির মধ্যে বাস করছে। এটি এমন একটি দেশ যা একই দিনে তার ইতিহাসের সবচেয়ে বিভাজনমূলক রাজনৈতিক রায়ের মুখোমুখি হয়েছে, নিষিদ্ধঘোষিত একটি দলের ডাকা ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে , 'দেখামাত্র গুলি' করার মতো কঠোর নিরাপত্তা আদেশের অধীনে শ্বাস নিচ্ছে , এবং একইসাথে, ২২ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া একটি ফুটবল ম্যাচের উন্মাদনায় গা ভাসাচ্ছে। 

আজ, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫-এর বাংলাদেশ একটি 'স্প্লিট-স্ক্রিন' বাস্তবতা এমন একটি জাতি যা একই সাথে ন্যায়বিচারের জন্য উল্লাস করছে , প্রতিশোধের ভয়ে কাঁপছে , এবং পেঁয়াজের আকাশছোঁয়া দাম নিয়ে হতাশায় ডুবছে। 

এটি একটি বিভক্ত আখ্যানের দেশ। একদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড; অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন 'রুটি-রুজি'র সংগ্রাম। এবং এই দুই বাস্তবতার মাঝখানে, একটি ফুটবল ম্যাচ  যেন ৯০ মিনিটের জন্য একটি 'জাতীয় যুদ্ধবিরতি'র প্রস্তাব দিচ্ছে। এই তিনটি রায়, রুটি এবং বল আজকের বাংলাদেশের জটিল এবং পরস্পরবিরোধী পরিচয়ের মূল চালিকাশক্তি।

গতকাল, ১৭ই নভেম্বর, ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ভূমিকম্পের দিন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) দেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী, ৭৮ বছর বয়সী শেখ হাসিনাকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই (in absentia) মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছে। একই সাথে, তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ গুরুতর: ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ট্রাইব্যুনালের ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ে শেখ হাসিনাকে সেই সময়ের রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের "মাস্টারমাইন্ড এবং প্রধান স্থপতি" হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলো হলো সহিংসতায় উসকানি দেওয়া, বিক্ষোভকারীদের হত্যার আদেশ জারি করা এবং নৃশংসতা প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়া। আদালতের ভাষ্যমতে, "শেখ হাসিনার আদেশ ও পূর্ণ জ্ঞাতেই" এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল।

এই মামলার রায় আরও জটিল হয়ে উঠেছে সাবেক পুলিশ প্রধান (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের কারণে। তাকে একই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও, তিনি 'রাজসাক্ষী' হওয়ায় এবং দোষ স্বীকার করায়  মাত্র পাঁচ বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন। এই পদক্ষেপটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় কৌশলগত জয়। এটি কেবল হাসিনা সরকারের অভ্যন্তরীণ কাঠামো থেকেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করে না, বরং পুরো প্রক্রিয়াটিকে 'রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টাকেও কঠিন করে তোলে।

আইসিটির এই রায় ঘোষণার সাথে সাথেই বাংলাদেশের রাজপথ দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

উল্লাসের আখ্যান: ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য এই রায় ছিল এক 'vindication' বা প্রতিদানের মুহূর্ত। তারা এই রায়কে "শহীদদের জন্য ন্যায়বিচার" হিসাবে দেখছে। রায় ঘোষণার পরপরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এবং শাহবাগ চত্বরে আনন্দ মিছিল বের হয়, মিষ্টি বিতরণ করা হয়। দেশের দীর্ঘদিনের বিরোধী দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), এই রায়কে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই রায় "ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছে"।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারও এই রায়কে আইনের শাসনের বিজয় হিসেবে তুলে ধরেছে। ড. ইউনূস এক বিবৃতিতে বলেছেন, এই রায় "নিশ্চিত করে যে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়"।

প্রতিশোধের আখ্যান: কিন্তু এই উল্লাসের চিত্রই সব নয়। রায়ের প্রতিক্রিয়ায়, নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী 'বাংলাদেশ বনধ' বা জাতীয় ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। এই ধর্মঘট কেবল ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। রায়ের আগে-পরে দেশজুড়ে সহিংসতা ও নাশকতার এক সমন্বিত অভিযান শুরু হয়েছে।

প্রতিবেদনগুলো অনুযায়ী, গত কয়েকদিনে অন্তত ৩০টি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে  এবং রায়ের দিনই দেশের পাঁচটি ভিন্ন জেলায় দুটি স্কুল ও আটটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বাস ও ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায়  জনমনে তীব্র আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

রাষ্ট্রের লৌহ-মুষ্টি: এই সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার জবাবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক চুলও ছাড় না দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী একটি কঠোর আদেশ জারি করেছেন, যা আজকের বাংলাদেশের ভয়ের বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত করছে: "দেখামাত্র গুলি" (shoot-at-sight)। এই আদেশ অনুযায়ী, অগ্নিসংযোগকারী, বোমাবাজ, বা পুলিশ ও জনসাধারণের উপর হামলাকারীদের দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনারও কয়েকদিন আগে একই ধরনের "ব্রাশফায়ার" নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এই কঠোর পদক্ষেপ একটি জটিল প্যারাডক্স তৈরি করেছে। যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, সেই সরকারই এখন স্থিতিশীলতা রক্ষার নামে একই ধরনের কঠোর (এবং কারো কারো মতে, স্বৈরাচারী) পদ্ধতি অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে।

আজকের বাংলাদেশের লড়াই শুধু রাজপথে নয়, বরং তা মনস্তাত্ত্বিক এবং প্রতীকী স্তরেও চলছে। এই প্রতীকী যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বাসভবন।

এই ভবনটি, যা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে পরিচিত, তা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আখ্যানের 'গ্রাউন্ড জিরো'। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর ফেব্রুয়ারী ২০২৫-এ এটি একবার আংশিকভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু রায়ের পর, 'জাতীয় ছাত্র শক্তি' নামে পরিচিত একদল হাসিনা-বিরোধী ছাত্র বিক্ষোভকারী ভবনটির "অবশিষ্ট অংশ ভেঙে ফেলার" চেষ্টা করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। 

কিন্তু এখানে একটি অদ্ভুত মোড় রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), লাঠিচার্জ, সাউন্ড গ্রেনেড এবং কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে এই বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে এবং ভবনটিকে রক্ষা করেছে। এই পদক্ষেপটি একটি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বার্তা দেয়। সরকার যেন শেখ হাসিনার 'অপরাধ'কে তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের 'উত্তরাধিকার' থেকে সচেতনভাবে আলাদা করতে চাইছে। তারা 'বঙ্গবন্ধু'-এর স্মৃতিস্তম্ভ রক্ষা করছে, যখন তাঁর কন্যার বিচার করছে।

একইসাথে, তথ্যের যুদ্ধক্ষেত্রেও সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা (এনসিএসএ) দেশের সমস্ত মিডিয়া আউটলেটকে একটি কড়া নির্দেশ জারি করেছে: "দণ্ডিত ও পলাতক" শেখ হাসিনার কোনো বিবৃতি বা বক্তব্য প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে না। সরকারের যুক্তি হলো, এই ধরনের বিবৃতি "সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা" উসকে দিতে পারে এবং "জাতীয় নিরাপত্তা" বিঘ্নিত করতে পারে। এই পদক্ষেপ কার্যকরভাবে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক কণ্ঠকে (যতই তিনি দণ্ডিত হন) সেন্সর করার সামিল, যা সরকারের 'লিবেরাল' বা উদারনৈতিক সমর্থকদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করছে। 

এই রায়ের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবও ব্যাপক, বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের ক্ষেত্রে। শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতেই নির্বাসনে রয়েছেন , যা প্রথম দিন থেকেই ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে এক "শীতল" বা "frosty" সম্পর্কের  জন্ম দিয়েছে।

রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ সরকার "অবিলম্বে" হাসিনাকে প্রত্যর্পণের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু ভারত পড়েছে এক জটিল diplomatic bind-এ। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত সতর্ক। তারা বলেছে, ভারত রায়টি "নোট করেছে" (taken note) এবং বাংলাদেশের "শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতার" প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই বিবৃতিতে হাসিনাকে রক্ষা করার কোনো প্রতিশ্রুতি যেমন নেই, তেমনি তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো ইঙ্গিতও নেই।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারত হাসিনাকে ফেরাবে না। ২০১৩ সালের দ্বিপাক্ষিক প্রত্যর্পণ চুক্তিতে একটি ধারা (Article 6) রয়েছে, যা "রাজনৈতিক চরিত্রের" অপরাধের ক্ষেত্রে প্রত্যর্পণে অস্বীকৃতি জানানোর সুযোগ দেয়। হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে, ভারত কার্যকরভাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের রাজনীতিতে তাদের প্রভাব ধরে রাখার জন্য একটি শক্তিশালী 'অস্ত্র' বা 'লেভারেজ' হাতে রাখল।

অন্যদিকে, জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থাগুলো একটি নৈতিক উভয়সঙ্কটে পড়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস  এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল  উভয়েই ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেও, মৃত্যুদণ্ডের মতো চূড়ান্ত শাস্তির বিরোধিতা করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বলেছেন, এই রায় "ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত", কিন্তু একই সাথে তিনি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় "দুঃখ প্রকাশ" করেছেন।

এর ফলে ড. ইউনূসের সরকার এক 'জবাবদিহিতা প্যারাডক্স'-এ পড়েছে। দেশের অভ্যন্তরে জনপ্রিয়তা ও ম্যান্ডেট ধরে রাখতে তাদের এই 'সর্বোচ্চ শাস্তি' কার্যকর করা প্রয়োজন, কিন্তু আন্তর্জাতিক বৈধতা ও সমর্থন পাওয়ার জন্য তাদের সেইসব পশ্চিমা মিত্রদের কাছেই যেতে হবে, যারা আদর্শগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী।

যখন দেশের আদালত, রাজপথ এবং দূতাবাসগুলো 'রায়' নিয়ে ব্যস্ত, তখন দেশের সাধারণ মানুষ (সাদারণ মানুষ) ব্যস্ত তাদের দৈনন্দিন 'রুটি'র সংগ্রাম নিয়ে। রাজনৈতিক এই ডামাডোলের আড়ালে, বাংলাদেশের রান্নাঘর বা 'কিচেন মার্কেট'-এ জ্বলছে আরেক আগুন।

রাজনৈতিক বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে, এটিই হয়তো আজকের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অ-রাজনৈতিক এবং সর্বজনীন 'ট্রেন্ড'।

  • ইলিশ মাছ: জাতীয় মাছ ইলিশ এখন সাধারণ মানুষের "নাগালের বাইরে"। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে এর দাম কেজিতে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গত সপ্তাহে যে ১ কেজি ওজনের ইলিশের দাম ছিল ২,২০০-২,৫০০ টাকা, তা আজ ৩,০০০ থেকে ৩,২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একজন ক্রেতার কথায়, "একটা ইলিশ মাছের দাম যদি ৫,০০০ টাকার বেশি হয়, মানুষ কিনবে কী করে?" 

  • পেঁয়াজ: রান্নার এই প্রধান উপকরণটির দাম "আকাশচুম্বী"। পুরানো মজুত শেষ হয়ে আসা এবং নতুন ফসল বাজারে না আসায়, ঢাকার বাজারে পেঁয়াজ প্রতি কেজি ১১০-১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে , যা কোনো কোনো বাজারে ১৫০ টাকাও ছাড়িয়ে গেছে।

  • অন্যান্য: দাম বৃদ্ধির এই তালিকা দীর্ঘ। কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ১০০-১২০ টাকা , টমেটো ১০০ টাকা , এবং আদা-রসুনও ১৪০ থেকে ১৬০ টাকার মধ্যে। 

এই অর্থনৈতিক চাপ এমন এক সময়ে ঘটছে যখন কিছু ইতিবাচক সামষ্টিক অর্থনৈতিক খবরও আসছে। নভেম্বরের প্রথম ১৫ দিনে রেমিট্যান্স প্রবাহে ২৩.১% প্রবৃদ্ধি হয়েছে , এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শিপিং জায়ান্ট মায়ারস্ক গ্রুপ (APM Terminals) চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া টার্মিনালে বড় বিনিয়োগের চুক্তি সই করেছে।

কিন্তু এই 'সামষ্টিক' ভালো খবরের সুফল 'ব্যক্তি' মানুষের রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। সরকার বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর থেকে শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিলেও , সাধারণ মানুষ "এখনও সংগ্রাম করছে"। সরকারের জন্য এটি একটি অশনি সংকেত। কারণ, রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি সাধারণ মানুষকে দীর্ঘ সময় ধরে পেটের ক্ষুধার কথা ভুলিয়ে রাখতে পারে না। 

এই দমবন্ধ করা রাজনৈতিক উত্তেজনা, সহিংসতা এবং অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে, আজকের বাংলাদেশ একটি তৃতীয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ইভেন্টের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে যা আজকের দিনের সবচেয়ে বড় 'প্রেসার রিলিজ ভালভ'।

আজ রাত ৮টায় , ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে  এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারত। 

এই ম্যাচের তাৎপর্য অদ্ভুত। প্রথমত, উভয় দলই ইতোমধ্যেই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেছে , তাই কাগজে-কলমে এই ম্যাচের কোনো গুরুত্ব নেই। দ্বিতীয়ত, ঠিক ২২ বছর পর ভারতের সিনিয়র ফুটবল দল ঢাকার মাঠে খেলতে এসেছে , যা ইভেন্টটিকে একটি ঐতিহাসিক মর্যাদা দিয়েছে। 

গুরুত্বহীন হয়েও এই ম্যাচটিই এখন 'টক অফ দ্য টাউন'। স্টেডিয়ামের সব টিকিট ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া আত্মবিশ্বাসী, তিনি বলেছেন, "ভারত এখন সেরা ফর্মে নেই" এবং দল জয়ের জন্য মুখিয়ে আছে। বাংলাদেশের ভক্তদের চোখ থাকবে প্রিমিয়ার লীগে খেলা তারকা হামজা চৌধুরীর দিকে , অন্যদিকে ভারতীয় ভক্তরা উৎসুক হয়ে আছে অস্ট্রেলিয়া-জাত OCI (ওভারসিজ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া) খেলোয়াড় রায়ান উইলিয়ামসের সম্ভাব্য অভিষেকের দিকে। 

এই ম্যাচটি নিছক একটি ফুটবল ম্যাচ নয়। এটি আজকের বাংলাদেশের জন্য এক বিরল 'একতাবদ্ধ' হওয়ার মুহূর্ত। যে ছাত্রনেতা হয়তো সকালে 'রায়'-এর পক্ষে স্লোগান দিয়েছেন, আর যে আওয়ামী লীগ সমর্থক 'ধর্মঘট' সফল করতে গিয়ে পুলিশের তাড়া খেয়েছেন আজ রাতে ৯০ মিনিটের জন্য তারা উভয়েই, সকল রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে, 'বাংলাদেশ' নামক একক পরিচয়ে একাত্ম হবেন।

এবং এই ম্যাচের প্রতিপক্ষ ভারত যে দেশটি এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে , সেই দেশটির বিরুদ্ধে একটি গোল বা একটি জয়, আজকের প্রেক্ষাপটে, নিছক ক্রীড়া বিজয়ের চেয়ে অনেক বেশি, এটি একটি গভীর প্রতীকী এবং মনস্তাত্ত্বিক বিজয়ে পরিণত হবে। 

সুতরাং, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫-এর বাংলাদেশ একটি 'থ্রি-বডি প্রবলেম'-এ আটকে আছে। একটি শক্তি তাকে টানছে অতীতের 'ন্যায়বিচারের' দিকে (রায়)। আরেকটি শক্তি তাকে ঠেলে দিচ্ছে ভবিষ্যতের 'অস্থিতিশীলতার' দিকে (সহিংসতা ও ধর্মঘট)। এবং তৃতীয় একটি শক্তি তাকে চেপে ধরে আছে বর্তমানের 'অস্তিত্বের সংকটে' (রুটি)।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আসল পরীক্ষা এখন শুরু। তাদেরকে কেবল রাজনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলেই চলবে না, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদেরকে শুধু রাজপথের সহিংসতা দমন করলেই চলবে না, সাধারণ মানুষের রান্নাঘরের আগুনও নেভাতে হবে।

আজকের বাংলাদেশ এই তিনটি পরস্পরবিরোধী শক্তির মধ্যে তার ভারসাম্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। আজ রাতের ফুটবল ম্যাচটি হয়তো কয়েক ঘণ্টার জন্য স্বস্তি দেবে, কিন্তু কাল সকালে আবার সেই একই প্রশ্ন নিয়ে সূর্য উঠবে রায়, রুটি, নাকি বল? কোনটি আগামীর বাংলাদেশকে সংজ্ঞায়িত করবে?

Nema komentara


News Card Generator