গাজা উপত্যকায় নতুন করে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে ইসরায়েলি আগ্রাসন। ‘অপারেশন গিডিয়ানস চ্যারিয়ট’ নামে সামরিক অভিযানের আওতায় মাত্র চার মিনিট অন্তর বোমা বর্ষণ করে একটি জনপদকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করা হচ্ছে। এই অভিযান যেন নতুন করে ইতিহাসের নৃশংসতম অধ্যায় রচনা করছে।
এই দখল অভিযানের লক্ষ্য শুধু হামাস নয়, বরং ক্রমশ তা সাধারণ জনগণের জীবন, অবকাঠামো, ও মানবিক অবলম্বনের উপর আঘাত হানছে। হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয় শিবির—কোনোটাই আর নিরাপদ নয়। গাজার বেতলাহিয়া, জাবালিয়া ও আশপাশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে ইসরায়েলি ট্যাংক, পদাতিক বাহিনী ও যুদ্ধবিমান একযোগে চালাচ্ছে তাণ্ডব।
নির্বিচারে ধ্বংস: হাসপাতাল থেকে শরণার্থী শিবির, কিছুই বাদ নেই
আক্রমণের ধরন এবং আকার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ। জাবালিয়ার রাস্তায় ট্যাংকের গর্জন, আকাশে বিমান হামলার শব্দ আর ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষের আর্তনাদ এখন গাজার প্রতিদিনের বাস্তবতা।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আইডিএফ জানিয়েছে, মাত্র একদিনে তারা হামাসের দেড় শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালিয়েছে। অথচ বাস্তবে এই ‘লক্ষ্যবস্তু’ মানে যেন জীবন্ত মানুষ, তাদের ঘরবাড়ি ও আশ্রয় শিবির।
প্রতি চার মিনিট অন্তর বোমা ফেলার যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে, তা শুধু কৌশলগত নয়—এই পদ্ধতিতে যেন গণহত্যার ছাপ লুকিয়ে আছে। বিশেষ করে বেতলাহিয়া ও জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে হামলার দৃশ্য দেখে অনেকেই একে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
অভিযানের তিন ধাপ: উচ্ছেদ, ধ্বংস আর দখলের সমন্বয়
এই অভিযানের অনুমোদন দিয়েছে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা ৪ মে তারিখে। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে ভয়ংকর যুদ্ধ প্রস্তুতি। ‘গিডিয়ানস চ্যারিয়ট’ নামটি এসেছে প্রাচীন ইহুদি বীর গিডিয়ানের নাম থেকে, যার স্মরণে এই আগ্রাসনকে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে একটি ঐতিহাসিক ‘পবিত্র যুদ্ধ’ হিসেবে।
তিন ধাপে ভাগ করা হয়েছে অভিযানটিকে—
প্রথম ধাপ: ‘পপুলেশন মবিলাইজেশন’। এ পর্যায়ে গাজার উত্তর অংশ থেকে জোরপূর্বক সাধারণ মানুষকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় ধাপ: বোমাবর্ষণ ও সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ‘অঞ্চল পরিষ্কার’ করা।
তৃতীয় ধাপ: দখল এবং পূর্ণ সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
এই তিন ধাপই বাস্তবায়িত হচ্ছে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে, যেখানে মানবিক দিকগুলো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত।
ট্রাম্পের সফর শেষে আগ্রাসনে নতুন মাত্রা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষ হওয়ার পর থেকেই গাজায় আগ্রাসন আরও তীব্র হয়েছে। দেশে ফিরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “গাজা একটি মুক্ত অঞ্চল হওয়া উচিত।” এই বক্তব্যের পরপরই ইসরায়েল যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে।
বিশ্ববিবেকের প্রতিক্রিয়া এখনো আশানুরূপ নয়। জাতিসংঘ বা ওআইসির পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর হস্তক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। অথচ গাজার প্রতিটি প্রান্তে মৃত্যুর মিছিল আর আর্তনাদ থামছেই না।
গাজা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন জনপদ
এই মুহূর্তে গাজা এমন এক জনপদে পরিণত হয়েছে, যেখানে শিশুর কান্না আর ধ্বংসের চিহ্ন প্রতিটি কোণে বিদ্যমান। ঘুমন্ত মানুষকে লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়া হচ্ছে, অ্যাম্বুলেন্স লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে, চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবকরাও বাদ পড়ছেন না আগ্রাসনের তালিকা থেকে।
‘গিডিয়ানস চ্যারিয়ট’ এক নতুন মানবিক বিপর্যয়ের নাম। এটি কেবল একটি সামরিক অভিযান নয়, এটি ইতিহাসের সেই অন্ধকার অধ্যায়—যা হয়তো ভবিষ্যতের বিশ্ববিবেককে লজ্জিত করবে।