আন্তর্জাতিক মঞ্চে এক যুগান্তকারী সমীকরণ তৈরি হয়েছে ইরানকে কেন্দ্র করে। ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনায় এবার একা নেই তেহরান। চারটি পরমাণু শক্তিধর দেশ—চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া—প্রকাশ্যে ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থান শুধু সামরিক সমর্থনের বার্তা নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের কূটনৈতিক ভারসাম্য পাল্টে দেওয়ার মতো শক্তিশালী ইঙ্গিত।
সম্প্রতি ইসরায়েলের একতরফা সামরিক পদক্ষেপ এবং ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের ঘটনায় মুসলিম বিশ্ব বিস্তৃতভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সৌদি আরব, তুরস্ক, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত পর্যন্ত নেতানিয়াহুর বিরোধিতায় গলা মিলিয়েছে। এই একমত অবস্থান যুগান্তকারী, কারণ অতীতে সৌদি ও ইরানের মধ্যে শীতল সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। এখন এই সংকট ইরানকে মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে এনেছে।
নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েল এক ধরণের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মুখে পড়েছে, যেখানে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কেউ প্রকাশ্যে তার পাশে নেই।
পাকিস্তান সরকার এই ইস্যুতে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। তারা বলেছে, ইরানে চালানো হামলা দেশটির সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ভয়াবহ লঙ্ঘন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই হামলা জাতিসংঘ সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। একইসঙ্গে তারা জাতিসংঘে জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার এই অবস্থান কেবল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে ভারত ও আমেরিকার পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থানের বিপরীতে এটি একটি নতুন কণ্ঠস্বর।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে চীন ও রাশিয়া। চীন এরইমধ্যে জাতিসংঘে তীব্র ভাষায় ইসরায়েলের নিন্দা করেছে এবং এটিকে "রেড লাইন অতিক্রম" বলেছে। চীনের বক্তব্য, ইরানের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে এবং এটি সহ্য করা হবে না।
অন্যদিকে রাশিয়া আরও শক্ত বার্তা দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এই হামলাকে "অত্যন্ত উদ্বেগজনক" বলে আখ্যা দেন এবং বলেন, "এই আক্রমণ কেবল একটি দেশের ওপর হামলা নয়, বরং পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা।"
এছাড়া রাশিয়ার কূটনীতিকরা সতর্ক করে বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক তৎপরতা রাশিয়ার কৌশলগত স্বার্থের পরিপন্থী হলে তার ফল ভালো হবে না।
উত্তর কোরিয়া ও ইরানের সম্পর্ক বহুদিন ধরেই আলোচনার বিষয়। বিশেষ করে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি ও সামরিক সহযোগিতা নিয়ে তাদের মধ্যে গোপন সমঝোতার অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক সংকটে পিয়ংইয়ং সরাসরি মন্তব্য না করলেও বিভিন্ন সূত্র বলছে, তারা পরোক্ষ সমর্থন দিচ্ছে এবং প্রয়োজনে প্রকাশ্যেও আসতে পারে।
কমন মিত্র রাশিয়ার মাধ্যমে এই সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। তাই কূটনৈতিক ভাষায় এটি পরিষ্কার, উত্তর কোরিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইরানের সঙ্গে থাকতে প্রস্তুত।
এই চতুর্মুখী ঘেরাওয়ের মধ্যে নেতানিয়াহু নিজের ঘরেই চাপে পড়েছেন। আমেরিকার বাইডেন প্রশাসন প্রকাশ্যে তাকে সমর্থন দিলেও আড়ালে বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়। এমনকি ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও নেতানিয়াহুর কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
নেতানিয়াহুর অবস্থান এখন ‘স্ট্র্যাটেজিক মিসক্যালকুলেশন’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।
ইরানের পক্ষে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর একত্রিত অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ ঘটিয়েছে। এটি শুধু সামরিক শক্তির প্রদর্শন নয়, বরং কূটনৈতিক ভারসাম্যের অদলবদল।
যুদ্ধের মাঠে এখন প্রশ্ন একটাই—নেতানিয়াহু ও তার মিত্ররা এই আন্তর্জাতিক চাপ কতদূর পর্যন্ত সামলাতে পারবে?



















