প্রগতি সরণির যানজটে আটকে আছে ‘প্রগতি’ই!
সুমন হাওলাদার
ঢাকা, ১২ মে ২০২৫
রাজধানী ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত সড়ক বাড্ডার প্রগতি সরণি এখন আর শুধুমাত্র একটি যাতায়াতপথ নয়—এটি একধরনের ধ্যানচর্চার কেন্দ্র, শ্লথগতির জীবন্ত স্মারক। এই পথে কেউ গন্তব্যে পৌঁছাতে চায় না—চাইলেও পারে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে আবার সকাল—এই সড়কে বসে আপনি করতে পারেন ধ্যান, সাধনা, এমনকি আত্মজিজ্ঞাসাও।
---
‘ভবিষ্যৎ থেমে আছে’ মুহূর্ত
সোমবার সকাল ১০টায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পুরো প্রগতি সরণি রূপ নিয়েছে এক ‘স্টেশনারি থিয়েটারে’। আশপাশে যতদূর চোখ যায়, শুধু বাস, রিকশা, সিএনজি, প্রাইভেটকার আর বিরক্ত মুখের মানুষে ঠাসা।
তবে আশার কথা, যানজটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো একে অপরের ‘ভাই ভাই’ হয়ে উঠেছে। এক যাত্রী জানালেন, “ভাই, এইখানে আর কেউ রাগ করে না, সবাই যেন একটাই পরিবার। এক ঘণ্টা দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে সবাই ভাই ভাই হইয়া যায়!”
---
বাসে ওঠা মানেই বসে থাকা
তুরাগ, ভিক্টর, রবরব, দেওয়ান, আলিফ, BRTC—সব বাসই যেন একই নাটকে অভিনয় করছে: ‘নড়বে না, সরে না’। কেউ জানালার পাশে বসে হাই তুলছে, কেউ ফেসবুক লাইভে বলছে, “এই দেখেন, আমি এখনো এইখানে”।
এক তরুণ অফিসযাত্রী ক্ষোভ নয়, বরং চমৎকার কৌতুকে বললেন, “আমি এখন ফ্রিল্যান্স জ্যামার। প্রতিদিন এইখানে বসেই কাজ করি।”
---
রিকশা বনাম ট্রাফিক পুলিশ: এক ‘নীরব চুক্তি’
যেখানে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ, সেখানেই তারা চলছে হেডলাইট উঁচিয়ে। আর পাশে নিরব দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ বাহিনী যেন কানে তুলো দিয়েছে।
রিকশাচালক বাবুল মিয়া বলেন, “ভাই, এইখানে রুল মানলে পেট চলবে না। যানজটই আমাদের গতি!”
ট্রাফিক সার্জেন্টের ভাষ্য, “সব গাড়িই তো এমনিতেই দাঁড়ায় থাকে। আলাদা করে থামানোর দরকার পড়ে না। এখন আমাদের কাজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফেসবুক চালানো।”
---
ফুটপাতের ফুটফাট অবস্থা
ফুটপাতের নাম শুনে কেউ ভাববেন হেঁটে চলার পথ, কিন্তু বাস্তবে তা দোকান, ফলের ঝুড়ি, চা-স্টল, ও বিলবোর্ডের এক বিশাল মিলনমেলা।
ফলে পথচারীদের কোনো বিকল্প থাকে না। বাধ্য হয়ে তারা নেমে পড়ে রাস্তায়—যেখানে আগে থেকেই দখল করে আছে গাড়ির সারি।
একজন পথচারী রসিকতা করে বললেন, “যখন রাস্তা গাড়ির, ফুটপাত দোকানের, তখন আমাদের পথ কি থাকবে না?”
---
যানজট: এখন এক নগর সংস্কৃতি
এই শহরে যানজট এখন কেবল ভোগান্তি নয়, এটি একটি জীবনধারা, একটি সংস্কৃতি।
প্রগতি সরণি তার নামের মতোই ঢাকার পরিকল্পনার পরিহাস—‘প্রগতি’ শব্দটাই এখানে কৌতুকের মতো শোনায়।
কেউ পৌঁছায় না ঠিকই, কিন্তু সবাই অপেক্ষায় থাকে। আর সেই অপেক্ষার মধ্যেই গড়ে উঠছে নগরের নতুন পরিচয়:
‘গন্তব্য নয়, গ্যাঁট হয়ে থাকা জীবন’।
---
শেষ কথা:
যানজট নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পরিকল্পনার কথা শোনা যায়, কিন্তু প্রগতি সরণিতে দাঁড়িয়ে মনে হয়—এই পরিকল্পনাগুলোও হয়তো এই রাস্তাতেই আটকে আছে।
আমরা এখনো দাঁড়িয়ে আছি। গন্তব্যে নয়, যানজটে!



















