বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ভিন্ন স্বরের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে যে মতামত দিয়েছে, তা শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং রাষ্ট্রকাঠামোর গভীর সংস্কারের দাবি। তাদের সুপারিশে যেমন আছে প্রধানমন্ত্রী-নির্ভর নয়, মন্ত্রীপরিষদ-নির্ভর শাসনব্যবস্থা, তেমনি আছে সংবিধানের মূলনীতি বাতিল করে তা নতুন করে লেখার দৃষ্টান্তমূলক প্রস্তাব।
এনসিপির মতে, একটি কার্যকর গণতন্ত্রে একজন ব্যক্তি একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে পারা উচিত নয়। এতে করে স্বৈরশাসনের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ বাধাগ্রস্ত হয়। এজন্য তারা সুপারিশ করেছে, দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দুই পদে (প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি) কেউ থাকতে পারবে না।
এনসিপির দাবি, দেশের শাসনব্যবস্থা হবে মন্ত্রীপরিষদ চালিত, যেখানে সমন্বিত নীতিনির্ধারণ হবে, কোনো একক ব্যক্তি একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করবে না। বিষয়টি বাংলাদেশের বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের সংস্কার হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
এনসিপি আরও একটি দৃষ্টান্তমূলক প্রশ্ন তুলেছে: সংবিধানের আদৌ মূলনীতি থাকা দরকার কিনা? তাদের ভাষায়, এতদিন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণকারী দলগুলো নিজেদের মত করে জনগণের উপর আদর্শ চাপিয়ে দিয়েছে। তাই তারা সংবিধানের মূলনীতি বাতিল করে নতুন করে তা লেখার পক্ষে মত দিয়েছে – যা দেশে সংবিধান নিয়ে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিতে পারে।
বহুল আলোচিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, যা সাংসদদের স্বাধীন মতপ্রকাশ রোধ করে, সেটির ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব এনেছে এনসিপি। শুধু অনাস্থা ভোট নয়, আরও অনেক বিষয়ে সাংসদদের স্বাধীনতা থাকা উচিত বলে মত দেয় দলটি।
গণহত্যার বিচার ও সংস্কারের রোডম্যাপ ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে এনসিপি। যদিও নির্বাচন পেছানোর পক্ষে নয় তারা। অর্থাৎ তারা চাইছে জবাবদিহিতার আওতায় সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বৈঠক শেষে জানান, সব দলের যেসব বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সম্মিলিত রূপরেখা তৈরি করার চেষ্টা চলছে।
এনসিপির প্রস্তাবসমূহ নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিন্নমাত্রার। যেখানে অন্য দলগুলো কেবল নির্বাচনকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার কথায় আটকে আছে, সেখানে এনসিপি সরাসরি রাষ্ট্রের কাঠামো ও সংবিধান নিয়েই নতুন করে ভাবার আহ্বান জানিয়েছে। এই আলোচনা আগামী দিনে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কারের চূড়ান্ত রূপরেখা নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।



















