শরিফ ওসমান হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ এক দ্বিমুখী বাস্তবতার মুখোমুখি। একদিকে ব্যক্তিগত শোক, অন্যদিকে সামষ্টিক আতঙ্ক ‘আমি কি নিরাপদ?’ এই প্রশ্ন যখন প্রতিটি নাগরিকের মনে, ঠিক তখনই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সংসদ সদস্যদের জন্য আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স এবং সশস্ত্র দেহরক্ষী (রিটেইনার) নিয়োগের নীতিমালা জারি করা হয়েছে। কিন্তু বন্দুকের নল দিয়ে কি আদৌ ভোটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব? নাকি এটি রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতারই নামান্তর? জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিল্লুর রহমান তার সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় তুলে এনেছেন এসব গভীর প্রশ্ন।
রাষ্ট্রের অসহায়ত্বের স্বীকারোক্তি? জিল্লুর রহমানের মতে, রাষ্ট্র যখন বলে দেয় প্রার্থীকে নিরাপদ রাখতে ব্যক্তিগত অস্ত্রের অনুমতি দরকার, তখন রাষ্ট্র মূলত দুটি বিপজ্জনক স্বীকারোক্তি দেয়। প্রথমত, প্রচলিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা এখন আর রাষ্ট্রের সর্বজনীন গ্যারান্টি নয়, বরং এটি ব্যক্তির অর্থ ও সক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। এই বার্তা সাধারণ মানুষের মনে ভীতি আরও বাড়িয়ে দেয় রাষ্ট্র যদি ভিআইপিদেরই বাঁচাতে না পারে, তবে আমজনতার কী হবে?
বৈধ অস্ত্রের আড়ালে অবৈধ দাপট বাংলাদেশের নির্বাচনের মাঠ মানেই আধিপত্য বিস্তার ও পেশিশক্তির মহড়া। জিল্লুর রহমান আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ভোটের মাঠে বৈধ অস্ত্রের এই নতুন প্রবেশাধিকার মূলত অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারকেই উৎসাহিত করবে। কাগজে-কলমে ভয় দেখানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, বাস্তবে কে কোন উদ্দেশ্যে অস্ত্র ব্যবহার করছে, তা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। এটি নির্বাচনী রাজনীতিকে ‘সিকিউরিটাইজ’ বা নিরাপত্তাকেন্দ্রিক করে ফেলবে, যেখানে স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার স্থান দখল করবে অস্ত্রের ঝনঝনানি।
অস্ত্র কি আদৌ জীবন বাঁচাতে পারে? সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর ধরন বিশ্লেষণ করে জিল্লুর রহমান বলেন, হাদির মতো ঘটনাগুলো ঘটে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে, খুব কাছ থেকে এবং মুহূর্তের মধ্যে। এমন আচমকা আক্রমণে ভিকটিমের কাছে অস্ত্র থাকলেও তা ব্যবহার করার সময় বা সুযোগ পাওয়া যায় না। উল্টো প্রতিপক্ষ যখন জানে টার্গেটের কাছে অস্ত্র আছে, তখন তারা আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে আগে গুলি করার সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ, অস্ত্র এখানে ‘ডিটারেন্স’ বা প্রতিরোধক না হয়ে সহিংসতার ‘এসকেলেশন’ বা বৃদ্ধিকারক হতে পারে।
কূটনৈতিক উত্তেজনা ও অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ভারতীয় হাই কমিশনের নিরাপত্তা ইস্যু এবং দুই দেশের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য জনমনে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। জিল্লুর রহমান সতর্ক করে বলেন, এই আঞ্চলিক উত্তাপের মধ্যে দেশের ভেতরে যদি অস্ত্রের সামাজিক উপস্থিতি বেড়ে যায়, তবে যেকোনো ছোট উস্কানি বড় ধরনের সংঘাতের দিকে মোড় নিতে পারে।
সমাধান কোন পথে? বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, সমাধান ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স বিতরণে নয়, বরং রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, গোয়েন্দা তথ্যের সমন্বয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ প্রার্থীদের জন্য সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা প্রোটোকল তৈরি করাই হলো সঠিক পথ। জিল্লুর রহমান মন্তব্য করেন, ‘‘বন্দুক হাতে দিলে কিছু মানুষ হয়তো সাময়িকভাবে আত্মবিশ্বাসী হবে, কিন্তু রাষ্ট্রের ওপর সমাজের বিশ্বাস কমে গেলে সেই ক্ষতি পূরণ করতে বহু প্রজন্ম লেগে যাবে।’’
নির্বাচনের বাকি আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ। এই সময়ে রাষ্ট্র কি ব্যক্তিগত অস্ত্রের ওপর ভর করবে, নাকি নিজের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।



















