দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকটে নাটকীয় মোড় নিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ৫ আগস্ট গণভবনে নিজের বড় বোন শেখ হাসিনার পা ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন শেখ রেহানা, তাকে পদত্যাগে রাজি করাতে।
রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকদের সামনে লিখিতভাবে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপন করেন তিনি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪ আগস্ট সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার আগে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠকে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বলপ্রয়োগ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা মানতে রাজি ছিলেন না।
তবে পরিস্থিতির বাস্তবতা এবং আন্দোলনের ভয়াবহতা বিবেচনায়, নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন—আরও বলপ্রয়োগ পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলবে। এই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানাকে ডেকে পরিস্থিতি জানান তারা।
শেখ রেহানা তখন বড় বোন শেখ হাসিনার কাছে যান এবং আবেগাপ্লুত হয়ে তাকে পদত্যাগের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তাতেও অনড় থাকেন শেখ হাসিনা। এরপর এক শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বিদেশে থাকা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জয় মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পরই অবস্থান পরিবর্তন করেন শেখ হাসিনা।
ততক্ষণে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আন্দোলনকারীরা গণভবনের দিকে রওনা দিয়েছে, এমন তথ্য পৌঁছে যায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে। মাত্র ৪৫ মিনিটে তারা গণভবনে পৌঁছাতে পারে এমন শঙ্কা থেকে শেখ হাসিনাকে ভাষণ রেকর্ডের সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পদত্যাগ করতে বলা হয়।
এরপর শেখ হাসিনা ছোট বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে যান। সেখানে তাদের লাগেজ উঠিয়ে বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বেলা আড়াইটার দিকে সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন শেখ হাসিনা।
ভারতীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানা গেছে, হেলিকপ্টারটি প্রথমে ত্রিপুরার আগরতলায় বিএসএফ হেলিপ্যাডে অবতরণ করে এবং পরে দিল্লিতে পৌঁছায়। ইন্ডিয়া টুডে জানায়, দিল্লির গাজিয়াবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিন্দন বিমানঘাঁটিতে স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিটে অবতরণ করেন তিনি। সেখান থেকে তিনি লন্ডনে যেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তাজুল ইসলামের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে টানা চারবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরমধ্যে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিতর্কের জন্ম হয়। ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’ নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের ‘ডামি’ নির্বাচনের পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ না থাকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ‘ডামি’ ব্যবহার করে নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা দেশজুড়ে ছাত্র আন্দোলন ও গণবিক্ষোভকে আরও তীব্র করে তোলে।
পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এই বিক্ষোভের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ছাত্র-জনতার অসহিষ্ণু আন্দোলনের মুখে সরকার পড়ে যায় চূড়ান্ত সংকটে। আন্দোলনের বিস্তার এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিকল্প আর ছিল না বলেই উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
দেশের ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথমবার কোনো প্রধানমন্ত্রী সেনা, পরিবার ও জনতার চাপে পদত্যাগ করে রাষ্ট্রীয় হেলিকপ্টারে দেশত্যাগ করলেন—যা দেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
এই ঘটনাপ্রবাহ একদিকে শেখ হাসিনার দীর্ঘ রাজনৈতিক অধ্যায়ের করুণ শেষ দৃশ্য, অন্যদিকে বাংলাদেশের গণআন্দোলনের এক যুগান্তকারী বিজয়ের চিত্র। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের প্রতিবেদনের এই তথ্য সামনে আসায় পুরো জাতি যেন আরও একবার উপলব্ধি করছে রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ও গণদাবির অপরিহার্যতা।